সোমবার সকাল ৬টায় দিনাজপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ৯৪ শতাংশ।
সূর্যের দেখা মিললেও ছিল না উত্তাপ। সঙ্গে ছিল হাড়কাঁপানো বাতাস। শীতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ের জনজীবন। গতকাল সোমবার দেশের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় দিনাজপুরে, ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ আবহাওয়ায় সবচেয়ে বিপদে পড়েছেন খেটে খাওয়া মানুষ। এই শীতে তাঁরা কাজে বের হতে পারছেন না। যাঁরা বের হচ্ছেন, তাঁরা কাজও পাচ্ছেন না।
দিনাজপুর আবহাওয়া কার্যালয় সূত্র জানায়, গতকাল সকাল ৬টায় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সকাল ৯টায় তা ছিল ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে বাতাসের আর্দ্রতা রেকর্ড করা হয়েছে ৯৪ শতাংশ। যেখানে গত রোববার সকাল ৬টায় তাপমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শহরের ষষ্ঠীতলা এলাকায় শ্রমের হাটে কাজের সন্ধানে আসা শাহজাহান আলী জানান, বিরল উপজেলার পলাশবাড়ি এলাকায় তাঁর বাড়ি। সাত কিলোমিটার সাইকেল চালিয়ে প্রতিদিন কাজের সন্ধানে ষষ্ঠীতলায় আসেন। তিনি বলেন, ঠান্ডার কারণে সকালে কাজে আসতে দেরি হয়। কাজও কমে গেছে। প্রতিদিনের আয়ের ওপর সংসার চলে। এখন টানাটানি পড়ে গেছে।
মহারাজা মোড় এলাকায় কথা হয় ইজিবাইকচালক বিমল কুমারের সঙ্গে। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে ১০টা পর্যন্ত বেশি ভাড়া পাওয়া যায়। মানুষ অফিস–আদালত, স্কুল-কলেজে যায়। কিন্তু সকালে এমন ঠান্ডা বাতাস থাকে যে বাড়ি থেকে বের হওয়াই যায় না। সন্ধ্যার পর থেকে শহরেও তেমন মানুষ থাকে না। দৈনিক যেখানে ৫৫০-৬০০ টাকা আয় হতো, সেখানে এখন ৩০০ টাকা রোজগার করা কঠিন হয়ে গেছে। সংসারের খরচ আর ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম অবস্থা।
শীতের পোশাকের দোকানে ভিড় করছে মানুষ। গোর–এ–শহীদ মাঠসংলগ্ন হকার্স মার্কেটে মানুষের উপচেপড়া ভিড়। ১০ বছর বয়সী ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে সোয়েটার কিনতে এসেছেন মোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, ‘তিনটা দোকান ঘুরলাম। ৩০০ টাকার নিচে সোয়েটার নাই। জ্যাকেটের দাম তো আরও বেশি।’
আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের কর্মকর্তা আসাদুজ্জামান বলেন, এক সপ্তাহ আগেও শীতের প্রকোপ কম ছিল। হঠাৎ তাপমাত্রা কমেছে। গতকাল সারা দেশের মধ্যে দিনাজপুরে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। কুয়াশা না থাকলেও বাতাসের বেগ বেশি ছিল। বাতাসের কারণে বেশি ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে।
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সকাল ৯টায় তেঁতুলিয়ায় দিনের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৯ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বাতাসের আর্দ্রতা ছিল ১০০ শতাংশ। চারদিক কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকায় দুপুর ১২ পর্যন্ত সূর্যের দেখা মেলেনি।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে সদর উপজেলার শিংপাড়া এলাকায় দেখা হয় রাজমিস্ত্রির সহকারী নজমুল হকের (৪৫) সঙ্গে। গায়ে চাদর, মাথায় মাফলার আর লুঙ্গি পড়ে বাইসাইকেল নিয়ে পঞ্চগড় শহরের দিকে কাজে যাচ্ছিলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আজকে কুয়াশায় কিচ্ছু দেখা যায় না। বাড়ি থেকে বের হয়ে শুধু কাঁপতেছি। তারপরও কী করা, কাজে তো যেতে হবে। কয়েক দিন ধরে বাতাস ছিল, কিন্তু তার সঙ্গে রোদও ছিল, এ জন্য এত কষ্ট হয়নি। আজকে মনে হয় আর বেলা (সূর্য) উঠবে না।’
শহরের অটো ভ্যানচালক জহিরুল ইসলাম (৪৮) বলেন, ‘ঠান্ডায় ভ্যানখান চালা যায় না, হাত-পাওলা খালি কাঁপেছে, কুয়াশা নাক-মুখোত ঢুকিলে নাক-চোখ দিলে পানি বাইর হচে, রোদ না উঠিলে বেশিক্ষণ ভ্যান চালা যাবেনি, আইজকা ভাড়াও (যাত্রী) কম হবে।’
ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের পুরোনো বাসস্ট্যান্ড এলাকায় প্রতিদিন শতাধিক শ্রমজীবী মানুষ কাজের সন্ধানে আসেন। গতকাল সকালে সেখানে হাজির ছিলেন মাত্র ৬০ জন। তাঁদের একজন তাহেরুল ইসলাম (৫৬)। তিনি বলেন, ‘কয়েক দিন ধরে সকালে কুয়াশার সঙ্গে বাতাস থাকিলেও সূর্য্যখান ঠিকই উঠিছিল। কিন্তু আইজ ঠান্ডা বাতাস শরীলত হুল ফোটাছে।’
ঠাকুরগাঁওয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তরের কোনো কার্যালয় নেই। তবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ঠাকুরগাঁও কার্যালয় এলাকার তাপমাত্রার হিসাব রাখে। ওই দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, কয়েক দিনে ধরে জেলার তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠানামা করছিল।
গতকাল সকাল নয়টার দিকে সদর উপজেলার আকচা, বকশেরহাট, ঢোলারহাট, বদেশ্বরী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চারদিক কুয়াশায় ঢেকে আছে। বইছে হিমশীতল বাতাস। রাস্তায় মানুষের চলাচল একেবারেই কম। পূর্ব আকচা এলাকার আলুখেতে সার দেওয়ার কাজ করছিলেন কয়েকজন নারী শ্রমিক। তাঁদের শরীর সোয়েটারে মোড়ানো। শ্যামলী রানী (৪২) বলেন, ‘ঠান্ডাত ঘর থাকিয়া বাহির হওয়া কষ্টকর হয়ে পড়িছে। কিন্তু কী করিব, খাওয়া জোগানের জন্য বাহির হবা হচে।’
শহরের রেলস্টেশন সড়কে সবজি বিক্রেতা হারিসুল ইসলাম বলেন, ‘মাঘ মাসের এই শীত হামাক কাহিল করি ফেলাইছে।’
[প্রতিবেদন তৈরি করতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও]