দুপুরে ভাত নিয়ে ছেলে সোহাগের (১৭) জন্য অপেক্ষায় ছিলেন মা সালমা বেগম। ছেলে জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফিরলে খেতে বলেন। ছেলে তখন বলে, ‘মা, আমি একটু পরে এসে খাব।’ মা ভাত নিয়েই বসে ছিলেন। কিন্তু ছেলে আর ফেরেনি। ফিরেছে তার গুলিবিদ্ধ লাশ।
রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় শাহজাদপুরে ছাত্র-জনতার কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশ নিয়ে গুলিতে ১৯ জুলাই বিকেলে নিহত হয় সোহাগ। উত্তর বাড্ডায় মা-বাবার সঙ্গে থাকত। কালার প্রিন্টের কাজ করত। বাবা রেজাউল রিকশা চালাতেন। বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলার শানেরহাট ইউনিয়নের বড়পাহাড়পুর গ্রামে।
বুধবার সকালে পীরগঞ্জের বড়দরগাহ থেকে ৮ কিলোমিটার পূর্বে সোহাগদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জীর্ণ ঘরের বারান্দায় বসে কাঁদছেন মা সালমা বেগম। উপস্থিত দুজন নারী তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আহাজারি করতে করতে সালমা বলছেন, ‘ওই পুলিশ তুই মোকো গুলি করি মারি ফেলাও। মুই মোর যাদুর গোড়োত থাকিম।’
নিজেকে সামলে নিয়ে সালমা বেগম বলেন, ‘সোহাগের বাপ বুড়া মানুষ। ইশকা (রিকশা) চলবার পারে না। মোরও হাড় ক্ষয় গেইছে। বিষোতে কিছু কইরবার পাও না। ছাওয়াটার কামাই দিয়া কষ্ট করি চলছিনো। সেই ছাওয়াক মিছিলোত গুলি করিয়া পুলিশ মারছে। বাবা রে, হাসিনা তো দ্যাশ ছাড়িয়াই পালাইল। মোর যাদুটাক না মারলে কি হইত না? হামাক এ্যালা কাঁয় খাওয়াইবে?’
সরেজমিনে দেখা যায়, জরাজীর্ণ টিনের ছাউনির একটি মাটির ঘর। মেঝে স্যাঁতসেঁতে, অগোছালো। ঘরের এক পাশে একটি কাঠের চৌকি। ঘরেই থাকেন সোহাগের দাদিসহ মা-বাবা। ঘরের ৫০ গজ দূরে অন্যের জমিতে সোহাগকে দাফন করা হয়েছে।
প্রতিবেশী অঞ্জলি রায় ও শাহিদা বেগম জানান, পৈতৃক দুই শতক বসতভিটাই রেজাউলের একমাত্র সম্বল। আগে এলাকায় রিকশা চালাতেন। সংসার না চলায় ২০০৭ সালে ১৯ দিন বয়সী শিশু সোহাগসহ বড় ছেলে সোহেলকে নিয়ে মা-বাবা ঢাকায় যান। কয়েক বছর পর বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা হয়ে যান। একপর্যায়ে রেজাউল বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারালে সংসারের হাল ধরে সোহাগ। উত্তর বাড্ডায় একটি প্রতিষ্ঠানে কালার প্রিন্টের কাজ করত। সর্বসাকল্যে বেতন পেত ১২ হাজার টাকা। সেই টাকায় ছোট্ট একটি কক্ষে কষ্টে চলত তাঁদের জীবন।
সোহাগের বাবা রেজাউল ইসলাম জানান, ১৯ জুলাই শুক্রবার সোহাগের ছুটি ছিল। জুমার নামাজ শেষে ফিরে কিছু না খেয়ে দ্রুত বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ওর মা ভাত নিয়ে ঘরে বসেই ছিলেন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে একজন রিকশাচালক বাসার সামনে এসে বলেন, সোহাগ নামের একটি ছেলে শাহজাদপুর বাজারে পুলিশের গুলি খেয়েছে। শুনেই হকচকিত হয়ে তিনি ছেলের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েন। বাজারে গিয়ে জানতে পারেন, পুলিশের গুলিতে আহত কয়েকজনকে স্থানীয় এমজেড হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। এরপর হাসপাতালে গিয়ে সোহাগের লাশ পান। স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় ২০ জুলাই লাশ গ্রামে এনে দাফন করেন।
প্রতিবেশী সহিদা বেগম বলেন, সোহাগের মা-বাবা খুবই হতদরিদ্র। সংসারে সোহাগের রোজগার একমাত্র ভরসা ছিল। সোহাগ মারা যাওয়ার পর তার মা-বাবা গ্রামে আছেন। তাঁরা কোনো কাজকর্ম করতে পারেন না। ছাত্র ও প্রতিবেশীদের সহযোগিতায় এ কয়েক দিন খেয়েছেন।
সোহাগের ভাবি নাসরিন বেগম বলেন, ছাত্রদের আন্দোলনে মিছিল করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে সোহাগ মারা গেল। অথচ ২৫ দিনে ছাত্ররা ছাড়া প্রশাসনের কেউ তাঁদের দেখতে আসেনি। আজকে রান্না করার মতো চালও ঘরে নেই।
পীরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ইকবাল হাসান মুঠোফোনে বলেন, পুলিশের গুলিতে নিহত সোহাগের বিষয়ে দাপ্তরিকভাবে তিনি কিছুই জানতে পারেননি। এ জন্য সেখানে যেতে পারেননি। তবে শুনেছেন, ঢাকায় আন্দোলন করতে গিয়ে গুলিতে সোহাগ মারা গেছে।