সিলেটে এক কাউন্সিলরের দাপটে তটস্থ এলাকার সবাই

জাহাঙ্গীর আলম
ছবি: সংগৃহীত

খাস জমি দখলে নিয়ে প্লট আকারে বিক্রি করেন তিনি। ওয়ার্ডের ভেতরে কেউ জায়গা বেচাকেনা করতে চাইলে বা বাড়ি বানাতে চাইলে তাঁকে দিতে হয় কমিশন। সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা চিনির সিন্ডিকেটেও নাম আছে তাঁর। দখলদারি, চাঁদাবাজি, চোরাচালানে জড়িত থাকার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি একজন জনপ্রতিনিধি। তাঁর দাপটে তটস্থ থাকেন এলাকার লোকজন। নগরের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর তিনি। জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদেও আছেন। নাম তাঁর জাহাঙ্গীর আলম (৪৫)।
সর্বশেষ ১০ জুন নগরের চামেলীবাগ এলাকায় টিলাধসে এক পরিবারের তিনজন নিহত হওয়ার পর নতুন করে এই কাউন্সিলরের নাম আলোচনায় আসে। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের মদদে ধসে পড়া ওই টিলা দফায় দফায় কাটা হয়েছিল। কেটে রাখা টিলাটি ভারী বৃষ্টিতে ধস পড়লে নিহতের ওই ঘটনা ঘটে।

জাহাঙ্গীর আলম—অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন।—জেলা ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন।—বর্তমানে সিলেট জেলা যুবলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক।—সিলেট নগরের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের নির্বাচিত কাউন্সিলর।

যুবলীগের এই নেতার বিরুদ্ধে এক যুগ আগে এমসি কলেজের ছাত্রাবাস পোড়ানো, বহিরাগত অস্ত্রধারীদের নিয়ে ক্যাম্পাসে মহড়া দেওয়ার অভিযোগও আছে। তখন তিনি ছিলেন ছাত্রলীগের নেতা।

২০১২ সালের ৮ জুলাই সন্ধ্যায় এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দিয়েছিলেন ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা-কর্মীরা। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম (গোল চিহ্নিত)

নানা অপকর্মে হন শিরোনাম

সিলেটে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ডজনখানেক নেতা-কর্মীর সঙ্গে কথা হয় এ প্রতিবেদকের। তাঁরা জানান, দুই যুগ আগেও সাধারণ জীবন যাপন করতেন জাহাঙ্গীর। একসময় যোগ দেন ছাত্রলীগের রাজনীতিতে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করলেও গুরুত্বপূর্ণ পদ বাগিয়ে নেন। পরে যোগ দেন যুবলীগে। এরপর যেন ‘আলাদিনের চেরাগ’ পাওয়ার মতোই বদলে যায় তাঁর জীবন। শুরু হয় বিলাসী জীবনযাপন। দামি গাড়ি সঙ্গী হয় তাঁর। গত বছরের ২১ জুন অনুষ্ঠিত সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তিনি ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর নির্বাচিত হন।
ছাত্ররাজনীতিতে সম্পৃক্ত হওয়ার পর থেকেই জাহাঙ্গীর ক্ষমতার অপব্যবহার করতে থাকেন। পাশাপাশি ছাত্রলীগের একাধিক আলোচিত সংঘর্ষে নেতৃত্ব দিয়ে পত্রিকার শিরোনাম হন তিনি, ছাপা হয় ছবিও।

২০১২ সালের ৮ জুলাই সিলেটে ছাত্রশিবির ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষের জেরে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে আগুন দেওয়ার পর ছাত্রলীগের আলোচিত মিছিলে সামনের সারিতে ছিলেন জাহাঙ্গীর। সেই ছবি তখনকার সময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।
২০১৩ সালের ১৯ মে নিজ ছাত্রসংগঠনের প্রতিপক্ষকে সিলেট এমসি কলেজের ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করতে এক বহিরাগত অস্ত্রধারীকে নিয়ে ক্যাম্পাসে যান তিনি। সেই ছবিও সে সময় প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছাপা হয়।
পাহাড়ধসের ঘটনা ছাড়াও কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর সম্প্রতি আলোচনায় আসেন সিলেট নগরে গৃহকর বাড়ানোর ঘটনা নিয়ে। নাগরিক অসন্তোষের মুখে গত ২২ মে সিটি মেয়র নাগরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভার আয়োজন করেছিলেন। সে সভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় জাহাঙ্গীর একজনের হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়েছিলেন।

২০১৩ সালের ১৯ মে সিলেটের এমসি কলেজে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষের সময় সামনে থেকে এভাবেই আগ্নেয়াস্ত্রের মহড়ার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীর আলম (গোল চিহ্নিত)

ভয়ে চুপ সবাই

জাহাঙ্গীরের বাসা সিলেট নগরের ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের মোহাম্মদপুর এলাকায়। তাঁর ওয়ার্ডের নয়জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কাউন্সিলরের অপকর্মের নানা ফিরিস্তি তাঁরা শোনান ঠিকই, কিন্তু নাম প্রকাশ করতে চাননি। তাঁরা জানান, জাহাঙ্গীরের দাপটে সবাই ভয়ে চুপ থাকেন। নিপীড়ন-নির্যাতনের ভয়ে তাঁর বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পান না।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওয়ার্ডের দুজন বাসিন্দা অভিযোগ করেন, ওয়ার্ডের ভেতরে কেউ জায়গা বেচাকেনা কিংবা বাড়ি বানাতে চাইলে জাহাঙ্গীরের প্রতিনিধিদের ‘বিশেষ কমিশন’ দেওয়া লাগে। ভবন নির্মাণেও তাঁর অনুগত ও সমর্থিত ব্যক্তিদের মাধ্যমেই বালু, পাথর, ইটসহ যাবতীয় নির্মাণসামগ্রী কিনতে হয়। নয়তো তাঁদের ‘চাঁদা’ দিতে হয়। এ ছাড়া জাহাঙ্গীরের মদদেই ওয়ার্ডে অধিকাংশ টিলা কেটে সমতল করা হচ্ছে। এর মধ্যে চামেলীবাগের একটি, উত্তর মোহাম্মদপুরের দুটি টিলা তিনি সরাসরি কাটাচ্ছেন বলে এলাকার একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছেন।

নিজ ওয়ার্ড ছাড়াও পাশের গুরুত্বপূর্ণ খাদিম বিসিক শিল্প এলাকা ও শাহপরান এলাকায় জাহাঙ্গীরের সহযোগীরা নিয়মিত চাঁদা তোলেন। মাদক বেচাকেনার অভিযোগও আছে জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে।
তাঁর বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন জাহাঙ্গীর। তিনি দাবি করেন, তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলোর একটিও ঠিক নয়। জায়গা বেচাকেনায় কোনো ওয়ার্ডে কাউকেই কখনো কমিশন দিতে হয় না। টিলা কাটার পেছনেও তাঁর কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

খাস জমি প্লট করে বিক্রি

সিলেট শহরতলির খাদিম চা-বাগানসংলগ্ন উত্তর মোহাম্মদপুর এলাকায় বিপুল পরিমাণ খাস জমি দখল করে প্লট আকারে বিক্রি করার অভিযোগ রয়েছে জাহাঙ্গীর আলম ও তাঁর ভাইদের বিরুদ্ধে। দুই দশক ধরে তাঁরা শতাধিক পরিবারের কাছে কমবেশি ২৫০ থেকে ৩০০ শতাংশ জমি বিক্রি করছেন বলে এলাকার কয়েকজন জানান।
১১ জুন বিকেলে সরেজমিনে দেখা গেছে, উত্তর মোহাম্মদপুর এলাকার খাস জায়গায় পাকা, আধা পাকা ও টিনশেডের অসংখ্য বসতি তৈরি করা হয়েছে। আশপাশে খাস জমিতে থাকা কয়েকটি টিলার অধিকাংশ কেটে সাবাড় করে ফেলা হয়েছে। অবিক্রীত খাস জমি বেষ্টনী দিয়ে প্লট করে বিক্রির জন্য রাখা আছে।

সিলেট নগরের চামেলীবাগ এলাকায় ১০ জুন একটি টিলার বড় অংশ ধসে পড়ে

সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে খাস জমি কেনার আগ্রহ দেখালে স্থানীয় তিন বাসিন্দা জানান, প্রতি ডেসিমেল (অর্থাৎ প্রতি শতাংশ) জমি গড়ে এক লাখ থেকে আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি হয়। তবে বিক্রির কোনো দলিল দেওয়া হয় না। মূলত মৌখিকভাবেই জমি বেচাকেনা চলে। কয়েকটি ক্ষেত্রে অবশ্য স্ট্যাম্প কিংবা সাদা কাগজে জমির মালিকানা ক্রেতাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়। একসময় জাহাঙ্গীরের বড় ভাই সেলিম আহমদ (এক বছর আগে প্রয়াত) জমি বেচতেন। তিনি মারা যাওয়ার পর জাহাঙ্গীর ও তাঁর আরেক বড় ভাই মোহাম্মদ মলন এ কাজ করছেন।
খাস জমিতে বসবাসরত এক বাসিন্দা জানান, এই এলাকা প্রথমে ফাতেমানগর নামে পরিচিতি পায়। এই ফাতেমা হচ্ছেন জাহাঙ্গীরের প্রয়াত ভাই সেলিমের স্ত্রী। সেলিম মারা যাওয়ার পর এলাকার নাম বদলে রাখা হয় উত্তর মোহাম্মদপুর। তবে এলাকায় প্রবেশের প্রধান সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে ‘সেলিম আহমদ সরণি’।
খাস জমি প্লট করে বিক্রি করা প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘না ভাই, ইলা কোনো ডকুমেন্ট থাকলে আমারে দেখাইবা। আফনে নিউজ করইন সমস্যা না, তবে তথ্যনির্ভর করবা। যদি কোনো প্রুফ (প্রমাণ) থাকে, তাহলে করবা।’

মামলা ও চোরাচালানে সম্পৃক্ততা

২০১৯ সালের ২ জুলাই সিলেট সদর উপজেলার খাদিমপাড়ায় যুবলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশের ওপরও হামলা হয়। পরে সিলেট মহানগরের শাহপরান থানা-পুলিশ বাদী হয়ে জাহাঙ্গীর আলমকে প্রধান আসামি করে পুলিশের ওপর হামলার অভিযোগে মামলা করে। এ মামলায় তিনি কিছুদিন কারাগারেও ছিলেন।
হলফনামায় জাহাঙ্গীর বিস্ফোরক দ্রব্য আইনসহ বিভিন্ন ধারায় তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি মামলা হওয়ার তথ্য উল্লেখ করেছেন। এর মধ্যে দুটি মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। অন্য মামলাটি চলমান আছে বলে তিনি হলফনামায় জানিয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জৈন্তাপুর উপজেলার সীমান্ত দিয়ে ভারত থেকে চোরাচালানের মাধ্যমে আসা চিনিসহ বিভিন্ন চোরাই পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে জাহাঙ্গীরের নিয়োজিত নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি ‘পুলিশকে ম্যানেজ করে’ নিরাপদে নগরে ঢুকতে সহায়তা করেন।

তবে চোরাই পণ্য নিরাপদে পরিবহনে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন জাহাঙ্গীর। তিনি বলেন, ‘আমার কিংবা আমার কোনো মানুষের এ কাজে সম্পৃক্ততা নেই।’
জাহাঙ্গীর আলমের এসব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আবদুল করিম চৌধুরী (কিম) প্রথম আলোকে বলেন, জাহাঙ্গীর আলম নানা নেতিবাচক ঘটনার জন্ম দিয়ে প্রায়ই আলোচনায় আসেন। অথচ প্রশাসন কিংবা তাঁর রাজনৈতিক দল এসব বিষয়ে নির্বিকার। বিষয়টি দুঃখজনক ও হতাশাব্যঞ্জক।