জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম

কুষ্টিয়ায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের এক কর্মকর্তার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা

কুষ্টিয়ায় বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহাঙ্গীর আলমের (৪০) মৃত্যু নিয়ে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা। পুলিশ বলছে, জাহাঙ্গীর আত্মহত্যা করেছেন। তবে পরিবারের সদস্যদের দাবি, জাহাঙ্গীরকে মেরে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।

এ ঘটনায় কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে আছেন থানাটির উপপরিদর্শক (এসআই) নজরুল ইসলাম। ঘটনার বিষয়ে জানতে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এই প্রতিবেদক অন্তত ১০ বার তাঁর মুঠোফোনে কল দেন। একপর্যায়ে তিনি ফোন ধরেন। জাহাঙ্গীরের মৃত্যু বিষয়ে জানতে চাইলে এসআই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ফোনে কিছু বলা যাবে না, নিষেধ আছে। আপনি থানায় আসেন, কথা হবে।’

পুলিশ ও জাহাঙ্গীরের পরিবার সূত্রে জানা যায়, জাহাঙ্গীরের বাড়ি টাঙ্গাইলের মধুপুরে। তিনি আমিরাত লুব ওয়েল কোম্পানির কর্মকর্তা ছিলেন। তিন বছর ধরে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। আড়াই বছর ধরে স্ত্রী ও দুই মেয়েকে নিয়ে কুষ্টিয়া শহরের কমলাপুর এলাকায় দোতলা একটি বাড়ির নিচতলায় ভাড়া থাকতেন। ৬ মার্চ বাসার কক্ষের সিলিং ফ্যানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাঁর স্ত্রী রুবিনা খাতুন বাইরে থেকে বাসায় ফিরে স্বামীর ঝুলন্ত লাশ দেখতে পান। পরে রুবিনা লাশটি নিয়ে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁর স্বামীকে মৃত ঘোষণা করেন। কুষ্টিয়া মডেল থানা-পুলিশ লাশটি হেফাজতে নেয়। পরে একই হাসপাতালে লাশটির ময়নাতদন্ত হয়।

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরের স্ত্রী রুবিনা খাতুন বলেন, ৬ মার্চ সকাল সাড়ে আটটার দিকে তিনি (রুবিনা) ও তাঁর স্বামী তাঁদের বড় মেয়ে জাহান রিদিকে নিয়ে স্কুলে রেখে বাসায় ফিরে আসেন। বাসায় এসে জাহাঙ্গীর তাঁকে জানান, অফিসের বড় কর্মকর্তা এসেছেন। তাঁকে সময় দিতে হবে। সারা দিন ব্যস্ত থাকবেন। সকাল সাড়ে ৯টার পর রুবিনা স্কুলে মেয়েকে আনতে যান। দুপুর ১২টার দিকে বাসায় ফিরে বাসার বারান্দার গ্রিলে বাইরে থেকে তালা লাগানো দেখতে পান। তাঁরা কখনই বাইরে থেকে গ্রিলে তালা লাগান না। তালা খুলে ভেতরে দরজা খোলা পান। তবে একটি চেয়ার দরজার সঙ্গে লাগানো ছিল। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে শোবার ঘরে ঢোকেন। পাশে খাবার ঘরে ঢুকে ফ্রিজের পাশে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে জাহাঙ্গীরকে ঝুলে থাকতে দেখেন। তিনি দ্রুত রশি কেটে জাহাঙ্গীরকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। লাশের ময়নাতদন্ত শেষে পরের দিন লাশটি তাঁদের কাছে হস্তান্তর করে পুলিশ।

লাশের ময়নাতদন্ত করেছেন হাসপাতালটির আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাপস কুমার সরকার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, তিনি গলায় রশি দিয়ে ঝুলে আত্মহত্যা করেছেন। তাঁর শরীরে কোনো আঘাতের চিহ্ন দেখা যায়নি। তদন্ত প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালটি এক চিকিৎসক বলেন, ‘যদি কোনো ব্যক্তিকে অচেতন করে ঝুলিয়ে রাখা হয়, তবে সেটা ময়নাতদন্তে আত্মহত্যা বলে বিবেচিত হয়। যদি সন্দেহ হয় যে তাঁকে অচেতন করা হয়েছে, তাহলে মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর রক্তসহ অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। কিন্তু সেটার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার বিষয়ে দেশে কোনো ব্যবস্থা নেই।’

জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরের বড় ভাই আবদুল খালেক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভাই খুবই ভালো মানুষ। কাজের প্রতি খুবই আন্তরিক ছিল। তার খুবই সুনাম ছিল কোম্পানিতে। সে আত্মহত্যা করতে পারে, এটা মানতে পারি না। সে আত্মহত্যা করার ছেলে না। কিন্তু কুষ্টিয়াতে আমাদের কেউ নেই। এ জন্য কোনো মামলা-মোকাদ্দমায় যাইনি। তবে পুলিশ যদি আরও তদন্ত করে, তাহলে ভালো হয়।’

রুবিনা খাতুন বলেন, তিনি (জাহাঙ্গীর) আত্মহত্যা করার মানুষ নন। ঘটনার দিন বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বাসায় কয়েকজন হিজড়া এসেছিলেন বলে জানতে পারেন। তাঁরা নাকি দ্রুত বেরও হয়ে গিয়েছিলেন। সে সময় একটি শব্দ হয়েছিল বলে জানতে পেরেছেন। রুবিনা আরও বলেন, ‘পুলিশ যদি আরও গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করত, তাহলে একটু শান্তি পাতাম। জানতে পারতাম, কেন, কিসের কারণে কী হলো।’

বর্তমানে রুবিনা খাতুন সাত বছরের মেয়ে জাহান রিদি ও ছয় মাসের মেয়ে সারাইয়া জান্নাতকে নিয়ে টাঙ্গাইলের মধুপুরে শ্বশুরবাড়িতে থাকছেন।

আমিরাত লুবে ওয়েল কোম্পানির এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপকালে নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, জাহাঙ্গীর ২০২১ সালে কোম্পানিতে যোগ দেন। তিনি সেরা কর্মকর্তা ছিলেন। কাজের প্রতি শতভাগ মনোযোগী থাকতেন। তাঁর সঙ্গে কখনো কাজ বা অন্য বিষয় নিয়ে কারও বিরোধ হতো না।

কুষ্টিয়া মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) দীপেন্দ্র নাথ সিংহ প্রথম আলোকে বলেন, এ ঘটনায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। মামলাটি এসআই নজরুল ইসলাম তদন্ত করছেন। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন এখনো হাতে পাননি। প্রতিবেদন পেলে সে অনুযায়ী, আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।