বিরামপুরের পশুহাটকে লোকসানে ফেলতে নিজ এলাকায় অবৈধভাবে পশুহাট বসান সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক।
গত শনিবার বেলা ১১টা। উত্তরবঙ্গের ঐতিহ্যবাহী গরুর হাটে তখন এঁড়ে বাছুর ও বকনা বাছুরের সংখ্যা মাত্র ২৭। আর মাঝারি আকারের গাভি ও বকনার সংখ্যা ২৩। গরুর হাটের মূল চত্বর বালুচরের মতো ফাঁকা পড়ে আছে। পাশে বাজারের চায়ের দোকান ঘেঁষে রাস্তায় বসেছে গরুর হাট।
হাট শুরুর দেড় ঘণ্টা পর হাসিল (খাজনা) আদায়কারী মিনহাজুল ইসলাম বললেন, এখনো একটি গরুও বিক্রি হয়নি। কয়েক বছর আগে যেখানে হাটবারে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ গরু বিক্রি হতো, সেখানে এখন সর্বোচ্চ ২৫০টি গরু বিক্রি হয়। আবার কোনো দিন বিক্রি হয় ৬০ থেকে ৭০টি গরু। প্রভাবশালী ব্যক্তিদের স্বার্থে কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের পশুর হাটটি এখন প্রায় বন্ধের পথে।
হাটটির অবস্থান দিনাজপুরের বিরামপুর শহরের পুরাতন বাজার এলাকায়। নাম বিরামপুর পৌর পশুহাট। জানা যায়, ২০১৫ সালে তৎকালীন মেয়র আজাদুল ইসলামের সময়ে পশুহাটটি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকায় ইজারা হয়েছিল। ২০২১ সালের দিকে সাবেক মেয়র লিয়াকত আলী সরকারের সময়ে সর্বশেষ ১ কোটি ৬০ লাখ টাকায় ইজারা হয় হাটটি। ২০১৫ সালের দিকে যে পাইকার ও ক্রেতাবান্ধব ব্যবস্থাপনা ছিল, সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে ইজারার মূল্য ১৫ থেকে ২০ কোটি টাকা হওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ব্যক্তিস্বার্থের কারণে পশুর হাটটি এখন বালুভরা মাঠ। চলতি বছরে উপজেলার পার্শ্ববর্তী ঘোড়াঘাট উপজেলায় আয়তনে ছোট রাণীগঞ্জ পশুর হাটের ইজারামূল্য ১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা হলেও বিরামপুর পৌর পশুহাটের ইজারামূল্য কমে দাঁড়িয়েছে ৯০ লাখ ৭ হাজারে।
এখন এই হাটোত আগের মতো আর সুযোগ–সুবিধা পায় না। ঠিকমতো নিরাপত্তা নাই। তাই বাইরের পার্টিরা আর এ্যাটে আসে না।আমিনুল ইসলাম, গরু ব্যবসায়ী
বিরামপুর পৌর পশুহাটে এখন দূরদূরান্তের ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগোনা নেই। নেই গরুর জন্য নিরাপত্তা ছাউনি ও গরু বাঁধার খুঁটি। প্রতি সপ্তাহের শনি ও মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পশুহাটের জায়গায় বসানো হয় সবজির পাইকারি বাজার। পশুহাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চার শতাধিক মানুষ জীবিকার তাগিদে বেছে নিয়েছেন বিকল্প পেশা।
বিরামপুর কলেজবাজার এলাকার গরু ব্যবসায়ী আমিনুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগে তো এই হাটোত ম্যালা গরু আসত। পুরা মাঠ বিভিন্ন গরু আর মহিষে ভরে যেত। বাইরের পাইকার ও গরুর মালিকেরা এখন এই হাটোত আগের মতো আর সুযোগ–সুবিধা পায় না। ঠিকমতো নিরাপত্তা নাই। তাই বাইরের পার্টিরা (পাইকার) আর এ্যাটে (এখানে) আসে না। কমদামি বাছুর আর গাইগরু এই হাটোত ওঠে। ভালো ও বড় বড় গরু আমবাড়ি, আফতাবগঞ্জ, রাণীগঞ্জ ও পাঁচবিবি হাটোত যায়।’
পশুহাটের এই অবস্থার জন্য সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক, উপজেলা চেয়ারম্যান ও মেয়রদের দায়ী করছেন স্থানীয় লোকজন। তাঁদের যোগসাজশে পছন্দের লোকজনকে ইজারা দেওয়া, পাইকার ও ক্রেতাদের গরু বেচাকেনার জন্য সুযোগ–সুবিধা না দেওয়া, হাটের অলিগলিতে গরু ব্যবসায়ীদের টাকা ছিনতাই আর দূরের ব্যবসায়ীদের জন্য আবাসিক সুবিধা না থাকার কারণে হাটের ইজারামূল্য কমে কোটি টাকার নিচে দাঁড়িয়েছে।
বিরামপুর পৌর পশুহাট ইজারার তথ্যানুযায়ী, শনিবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা দিনে ২৫১টি গরু আর ৩৭৮টি ছাগল বিক্রি হয়েছে। ৫ আগস্টের আগে শনিবার সর্বোচ্চ ৩০টি ও মঙ্গলবারে সর্বোচ্চ ২০টি গরু বিক্রি হতো। এসবের মধ্যে বাছুরের সংখ্যাই ছিল বেশি। ১০ বছর আগে যে হাটে বিক্রির জন্য দুই হাজারের বেশি মহিষ উঠত, এখন সেখানে হাটবারে সারা দিনে একটি মহিষও চোখে পড়ে না।
গরু ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ২০১৫ সালের দিকে পার্শ্ববর্তী নবাবগঞ্জ উপজেলায় নিজের দাদার নামে আফতাবগঞ্জে অবৈধভাবে গরুর হাট বসিয়েছেন সাবেক সংসদ সদস্য শিবলী সাদিক। বিরামপুরের পশুহাটকে লোকসানে ফেলতে বিরামপুরের সঙ্গে মিল রেখে আফতাবগঞ্জে একই দিনে (প্রতি শনি ও মঙ্গলবার) গরুর হাট বসছে। আফতাবগঞ্জের হাটকে জমজমাট করতে দুই সাবেক মেয়রের যোগসাজশে বিরামপুর পৌর পশুহাটকে দলীয় ও নিজের লোককে ইজারা দিয়েছেন শিবলী সাদিক। ইচ্ছা করেই ভেতরের অবকাঠামো, রাস্তা, নিরাপত্তা ও গরু ব্যবসায়ীদের সুযোগ–সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে, আফতাবগঞ্জ পশুহাটে এসব সুবিধার উন্নয়ন ঘটাতে সব ধরনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করেছেন শিবলী সাদিক।
শুধু তাই নয়, সরকারি হিসাবে যেখানে প্রতিটি গরু বিক্রির খাজনা (হাসিল) ৫৫০ থাকার কথা। সেখানে আফতাবগঞ্জ পশুহাটে বাহিরের জেলার গরু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে গরুপ্রতি ৩০০ টাকা ও স্থানীয় ক্রেতাদের কাছ থেকে ৪৫০ টাকা খাজনা নেওয়া হয়। এ ছাড়া বিরামপুর পৌর পশুর হাটে গরুর ক্রেতা–বিক্রেতা কমাতে আফতাবগঞ্জ পশুহাটে আসা গরু ব্যবসায়ীদের জন্য উত্তরবঙ্গের বিনোদনকেন্দ্র স্বপ্নপুরীর আবাসিক হোটেলে থাকার ব্যবস্থা, নিরাপত্তা ও গরুর কেনাবেচা করতে হাটের পক্ষ থেকে আর্থিক সুবিধাও দেওয়া হয়।
বিষয়টি নজরে আনা হলে বিরামপুর পৌরসভার প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) সোহাগ চন্দ্র সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আগে বিরামপুর পশুহাট সম্পর্কে বিস্তারিত জেনে নেই। তারপর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’