ইউনুস আলীরা আট ভাই, পাঁচ বোন। বাবা আছাবুদ্দিন ছিলেন কৃষক। একসময় ভাইয়েরা পৃথক হলে ইউনুস আলী বাবার জমি ভাগে পান তিন একর। সেই জমিতে ধান চাষের আয়ে চলত ইউনুসের সংসার। পরিবারে সদস্যসংখ্যা ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বাড়ায় শুধু ধান চাষের আয়ে কুলাতে পারছিলেন না তিনি। তাই পাশাপাশি কিছু করার চিন্তা করেন।
সাত বছর আগের কথা, ইউটিউবে ভেড়া পালনে স্বাবলম্বী হওয়ার ভিডিও দেখেন ইউনুস। তাঁরও মনে ইচ্ছে জাগে ভেড়া পালনের। ধান বিক্রির ১৭ হাজার টাকায় হিলি থেকে ৫টি ভেড়া কিনে আনেন। পাঁচটি ভেড়া থেকে ইউনুসের খামারে এখন ৯০টি ভেড়া। প্রতি মাসে সব খরচ বাদে এখন তাঁর আয় ৩০ হাজার টাকা। সংসার খরচ, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ দিয়েও এখন টাকা সঞ্চয় করতে পারেন তিনি। তাঁকে দেখে প্রতিবেশীসহ আশপাশের গ্রামের লোকজনও ভেড়া পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন।
ইউনুসের বাড়ি রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালী ইউনিয়নের বামনদীঘি গ্রামে। গ্রামটির একদিকে রংপুর-দিনাজপুর মহাসড়ক বাকি তিন পাশে সবুজ শ্যামল ফসলের মাঠ। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির উঠানে দেশি গরু, ছাগল, ভেড়ার পাল বাঁধা, হাঁস-মুরগির বিচরণ।
ইউনুসের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে ভেড়াগুলোকে দল করে গাছের পাতা ও কাটা খড় খাওয়াচ্ছিলেন তিনি। সেখানে বসেই ভেড়া পালনে স্বাবলম্বী হওয়ার গল্প শোনান ইউনুস।
ইউনুস জানান, ১৯৭৯ সালে একান্নবর্তী পরিবারে জন্ম তাঁর। ১৩ ভাইবোনের মধ্যে তিনি সপ্তম। ১৯৯৪ সালে এসএসসি পাস করেন। চাকরির সুযোগ পেলেও বাবা বড় কৃষক হওয়ায় যোগ দেওয়া হয়নি। ১৯৯৬ সালে বিয়ের পর ভাইয়েরা পৃথক হলে বাবার জমিতে থেকে তিন একর জমি ভাগ পান তিনি। এ জমিতে ধান চাষ করেই সংসার চলত তাঁর। তবে পরিবারে সদস্যসংখ্যা বাড়ে, বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম বাড়ায় ধান চাষের আয় দিয়ে টিকতে পারছিলেন না। মাস শেষে মোটা অঙ্কের দেনা হতে থাকে। একপর্যায়ে ঋণের টাকা শোধ দিতে আবাদি জমি বন্ধক দিতে হয়।
২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। এ সময় প্রতিবেশী ভাতিজার মুঠোফোনে ইউটিউবে ভেড়া পালনে স্বাবলম্বী হওয়ার ভিডিও দেখেন ইউনুস। সেই স্বপ্ন তাঁকেও পেয়ে বসে। ধান বিক্রির টাকায় সে মাসেই দিনাজপুরের হিলি থেকে ১৭ হাজার টাকা দিয়ে ৫টি ভেড়া কিনে আনেন। মাঠে, সড়কের ধারে ভেড়া চরানো শুরু করেন। এতে আর পিছু ফিরতে হয়নি তাঁকে। প্রথম বছরে পাঁচটি ভেড়ার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৩টিতে। এভাবে প্রতিবছর ভেড়া বাড়ে, আয় বাড়ে, বাড়ে খামারের পরিধি।
ইউনুস বলেন, ‘পাঁচ মাস পরপর ভেড়া বাচ্চা দেয়। একটি ভেড়া একবারে দুটি থেকে তিনটি পর্যন্ত বাচ্চা দেয়। ভেড়ার খাবার সহজলভ্য, জায়গাও লাগে কম। পথের ধারে, মাঠে চরালেই ভেড়ার খাবার পাওয়া যায়। ৫টি ভেড়া দিয়ে শুরু করে এখন আমার ৯০টি ভেড়া আছে। প্রতি মাসে ভেড়া বিক্রি করে ৩০ হাজার টাকা আয়ও হচ্ছে। একসময় সংসারের খরচ চালাতে জমি বন্ধক দিতে হয়েছে। এখন ভেড়া পালনের আয় দিয়ে স্ত্রী–সন্তান নিয়ে সুখে আছি। সঞ্চয়ের টাকা দিয়ে জমি কিনেছি। আশপাশের লোকজনও আমার কাছ থেকে ভেড়া কিনে লালন–পালন করছেন।’
দিনমজুরির কাজ করে সংসার চলত না পাশের বালাবাড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলামের। ইউনুসের খেতে কাজ করতে এসে কষ্টের কথা জানান তিনি। পরে ইউনুসের পরামর্শে তাঁর খামার থেকে দুটি ভেড়া কিনে লালন–পালন শুরু করেন সাইফুল। এখন তাঁর খামারে ৩০টি ভেড়া আছে।
সাইফুল বলেন, ‘আগে দিনমজুরি করে দুবেলার খাবার জুটানো কষ্টকর ছিল। ইউনুসের ভাইকে দেখে ভেড়া পালন করে এখন ভালোই দিন যাচ্ছে। ২টি ভেড়া দিয়ে শুরু করলেও চার বছরে এখন আমার খামারে ৩০টি ভেড়া আছে। আল্লাহ দিলে এখন আর ভাত–কাপড়ের অভাব নেই।’
বালাবাড়ি গ্রামের সোনা মিয়ার খামারেও এখন ২০টি ভেড়া। তাঁর ভেড়া পালন শুরু ইউনুসকে দেখে। সোনা মিয়া বলেন, ‘ইউনুস ভাইয়ের এত জমিজমা থাকতেও রাস্তাত মাঠোত ভেড়া চরান। ভাইয়ের দেখি, আমিও তিন বছর আগে ৪টি ভেড়া দিয়ে খামার শুরু করি। এখন ২০টি ভেড়া আছে। ভেড়া বিক্রি করি এখন মাসে ১০ হাজার টাকা আসে। শুধু আমি নই; খরচ কম, ঝুঁকি কম, লাভ বেশি হওয়ায় আমার মতো আশপাশের গ্রামের অনেকেই এখন ভেড়া পালন করছেন।’
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ইফতেখায়ের আলম বলেন, ইউনুস একজন আদর্শ খামারি। তাঁকে দেখে আশপাশের মানুষ ভেড়ার খামার করছেন। তাঁর গ্রামসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে ভেড়া পালন বাড়ছে। গরু ও ছাগলের তুলনায় ভেড়ার মাংস অনেক বেশি স্বাস্থ্যবান্ধব। এতে কোলেস্টেরলের পরিমাণ কম থাকায় সব বয়সের মানুষ তা গ্রহণ করতে পারে। ভেড়া পালনের ফলে একদিকে যেমন নিরাপদ মাংসের জোগান দিচ্ছে, অন্যদিকে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তি মিলছে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ সব সময় ভেড়া পালনকারীদের উৎসাহ–সহযোগিতা দিয়ে আসছে।