সাদ্দাম হোসেন (৩৫) ছোট থেকেই পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্য দিয়ে বড় হয়েছেন। জীবিকার তাগিদে একসময় কাজ করতেন বিক্রয় প্রতিনিধি হিসেবে। সাড়ে তিন হাজার টাকা বেতনে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরিও করেছেন। কিন্তু তাতে সংসার না চলায় ২০১০ সালের দিকে রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন। প্রায় পাঁচ বছর এ পেশায় ছিলেন তিনি। একসময় হয়ে ওঠেন পুরোদস্তুর রাজমিস্ত্রি।
তবে রাজমিস্ত্রির কাজ করার সময় অনলাইনে আয় করার উপায় খুঁজতে থাকেন সাদ্দাম। একপর্যায়ে ২০১৩ সাল থেকে কাজের ফাঁকে ফাঁকে অনলাইনে শিখতে থাকেন ‘ওয়েব ডিজাইন’। ধীরে ধীরে তিনি ফ্রিল্যান্সিংয়ের আরও বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেন। কাজ শেখার পর সাদ্দাম হোসেন অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে আয় করতে শুরু করেন। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি সাদ্দামকে। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিং করে প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা আয় করছেন তিনি।
সাদ্দাম হোসেনের বাড়ি নড়াইল সদর উপজেলার উপশহরে। চার ভাই–বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। সফলতার গল্প শুনতে চাইলে, সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমি অতি সাধারণ পরিবারে জন্মেছি। সংসারের হাল ধরতে নানা পেশায় কাজ করেছি। সেসব কাজের পরিশ্রমের তুলনায় প্রাপ্তি ছিল খুবই কম। তখনই ভাবলাম, জীবন বদলাতে হলে ভিন্ন কিছু করতে হবে। ২০১৩ সালে প্রথম অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে জানতে পারি। কীভাবে কাজ শুরু করব, তা জানতাম না। কোনো ভালো প্রশিক্ষক পাইনি। পরে ইউটিউব ও ইন্টারনেট ঘেঁটে নিজেই ওয়েব ডিজাইন শেখা শুরু করি।’
সাদ্দাম জানান, ২০১৬ সাল থেকে অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ও মার্কেটপ্লেসের বাইরে নিয়মিত কাজ করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে মার্কেটপ্লেসে তেমন ক্লায়েন্ট পেতেন না। তবে মার্কেটপ্লেসের বাইরে অনেক ক্লায়েন্ট ছিল। ধীরে ধীরে ফ্রিল্যান্সার মার্কেটপ্লেসেও ক্লায়েন্ট আসতে শুরু করে। এরপর তিনি ডিজিটাল মার্কেটিং, ওয়েব ও গ্রাফিক ডিজাইনের বিভিন্ন কাজে দক্ষতা অর্জন করেন। বর্তমানে এসব কাজের পাশাপাশি ইউটিউব ও ফেসবুকে কনটেন্ট তৈরি করেন। সেখান থেকেও ভালো আয় হচ্ছে।
নড়াইল শহরের গারোচোরা এলাকায় জমি কিনে একতলা একটি বাড়ি করেছেন সাদ্দাম। উপশহর বাজারে জায়গা কিনেছেন। সেখানে মার্কেট নির্মাণ করবেন। চাষাবাদের জন্য ১৬৩ শতক জমি কিনেছেন। দুই সন্তান, স্ত্রীসহ পরিবারের সবাইকে নিয়ে এখন সচ্ছল সংসার তাঁর।
২০১৬ সাল থেকে অনলাইন মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ও মার্কেটপ্লেসের বাইরে নিয়মিত কাজ করতে শুরু করেন। প্রথম দিকে মার্কেটপ্লেসে তেমন ক্লায়েন্ট পেতেন না। তবে মার্কেটপ্লেসের বাইরে অনেক ক্লায়েন্ট ছিল। ধীরে ধীরে ফ্রিল্যান্সার মার্কেটপ্লেসেও ক্লায়েন্ট আসতে শুরু করে।
সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, কঠোর পরিশ্রম আর শেখার ইচ্ছা, সবচেয়ে বড় শক্তি। জীবনে অনেক বাধা এসেছে, কিন্তু হাল ছাড়িনি। প্রতিটি চ্যালেঞ্জকে আমি নতুন সুযোগ হিসেবে নিয়েছি। এ কারণেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে আমার ভাগ্য বদলেছে। আল্লাহর রহমতে জায়গাজমি ও গাড়ি-বাড়ি সবই করেছি। সন্তানদের ভালোভাবে মানুষ করতে পারছি।’
ফ্রিল্যান্সিং করে সাদ্দাম যে কেবল নিজে সফল হয়েছেন, তা কিন্তু নয়। অনেক বেকার তরুণের ভাগ্য বদলে কাজ করছেন তিনি। সরাসরি ও অনলাইনে সাদ্দামের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেকের বেকারত্ব ঘুচেছে। তাঁরা নিজেরা যেমন দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হয়ে ভালো উপার্জন করছেন, তেমনি অন্যদেরকেও শেখাচ্ছেন।
সাদ্দাম হোসেনের কাছ থেকে অনলাইনে প্রশিক্ষণ নিয়ে ফ্রিল্যান্সিং করছেন ময়মনসিংহের আমিনুল ইসলাম। মুঠোফোনে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বড় বড় ফ্রিল্যান্সাররা সময়ের অভাবে শেখাতে পারেন না, আর ইউটিউব বা ফেসবুক দেখে শিখতে গেলেও অনেক সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হতে হয়। এমনকি টাকার বিনিময়ে পাওয়া কোর্সেও হাতে-কলমে শেখার অভাব থেকে যায়। কিন্তু সাদ্দাম স্যার ব্যতিক্রম। তিনি বিনা মূল্যে আমাদের জন্য সময় দিয়েছেন এবং ধৈর্যের সঙ্গে প্রতিটি বিষয় শিখিয়েছেন। তাঁর কাছ থেকে ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে এখন আমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছি। আমিও অনেক বেকার তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাঁদের স্বাবলম্বী করতে সহায়তা করছি।’
আমার স্বপ্ন, বাংলাদেশে আরও বেশি মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে আসুক এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নিজেরা সচ্ছল হোক, দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখুক।সাদ্দাম হোসেন, ফ্রিল্যান্সার
রফিকুল ইসলাম নামের আরেকজন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সাদ্দাম হোসেনের কাছে বিনা মূল্যে ডিজিটাল মার্কেটিং কোর্স করেছিলেন। চাকরি ছেড়ে তিনি নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান করেছেন। রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমি বর্তমানে বিলবাজার নামের একটি অনলাইন ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম পরিচালনা করছি। আমার এখন মাসে আয় এক থেকে দেড় লাখ টাকার মধ্যে। সাদ্দাম স্যারের প্রশিক্ষণ ও প্রেরণা আমাকে আজকের অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।’
সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘আমি চাই আরও তরুণ-তরুণীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে সফল হতে সাহায্য করতে। আমি স্বল্প পরিসরে সরাসরি ও অনলাইনে ক্লাস করাই, যেখানে বিনা মূল্যে আগ্রহীরা শেখার সুযোগ পান। আমার স্বপ্ন, বাংলাদেশে আরও বেশি মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ে এগিয়ে আসুক এবং বৈদেশিক মুদ্রা আয় করে নিজেরা সচ্ছল হোক, দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখুক।’