কৃষকেরা হাওরে চাষ করা বোরো ধানের ওপর নির্ভরশীল। এখন বৃষ্টি হলেই ফসল ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা।
এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর পরও সুনামগঞ্জের হাওরগুলোতে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) এখন পর্যন্ত ৯৫ ভাগ কাজ শেষের দাবি করলেও কৃষকনেতারা বলছেন, ৬৫ থেকে ৭০ ভাগের মতো কাজ হয়েছে। এতে ক্ষুব্ধ কৃষকেরা সমাবেশ করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার জন্য সংশ্লিষ্টদের গাফিলতিকে দায়ী করছেন কৃষক নেতারা। ‘হাওর বাঁচাও আন্দোলনের’ সভাপতি বিজন সেন রায় বলেন, শুরুতে কাজে গতি থাকে কম, শেষ দিকে শুরু হয় তাড়াহুড়া। এতে কাজের মান ঠিক থাকে না। কাজে নানা অনিয়ম–অবহেলার কারণেই হাওরের ফসল ঝুঁকিতে পড়ে।
পাউবো সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জের ৯৫টি হাওরের মধ্যে ৪০টি হাওরে এবার ৫৯১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে ৭৩৪টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩০ কোটি টাকা। গত ১৫ ডিসেম্বর শুরু হয়ে কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হয়নি।
অনেক প্রকল্পে মাটির কাজই শেষ হয়নি
মাটিয়ান হাওরের ফসল রক্ষায় তাহিরপুর উপজেলার বৌলাই নদের উত্তর পারে রতনশ্রী গ্রাম থেকে পুঁটিমারা পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটারজুড়ে ৯টি প্রকল্পে বেড়িবাঁধের সংস্কার চলছে। গত বৃহস্পতিবার সরেজমিন দেখা যায়, তিনটি প্রকল্পে এখনো মাটির কাজই শেষ হয়নি। অন্যগুলোতে মাটির কাজের পর ঢালে ঘাস লাগানো ও মাটি শক্ত করার কাজ চলছে।
হাওরের দুর্গম এলাকা পুঁটিমারায় গিয়ে দেখা যায় ৩৩ ও ৩৪ নম্বর প্রকল্পে এলোমেলোভাবে মাটি ফেলে রাখা হয়েছে। আরও কয়েকটি ট্রাকে মাটি ফেলা হচ্ছে। সেখানে থাকা দুজন কৃষক জানান, এই কাজ শুরু হয়েছে ১ মার্চ। মাটি ফেলা, মাটি শক্ত করা ও ঘাস লাগাতে আরও ১০ দিন লাগবে। এ বিষয়ে পিআইসির প্রতিনিধি সায়েদ মিয়া বলেন, বৃষ্টি হওয়ায় প্রায় এক সপ্তাহ কাজ করতে পারেননি।
যেসব কারণে শেষ হয় না কাজ
স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু না করায় শেষ করতেও দেরি হয়। এ ছাড়া পানি ধীরে নামা, প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনে বিলম্ব, অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, সময়মতো অর্থ বরাদ্দ না দেওয়া এবং কাজে অবহেলা ও অনিয়ম রয়েছে।
বাঁধের কাজ প্রায় শেষ দাবি করে সুনামগঞ্জ পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন হাওলাদার বলেন, অনেক সময় হাওরের পানি ধীরে নামে, বৃষ্টি হয়। পিআইসি গঠনে জটিলতা থাকে। তাই নির্ধারিত সময়ে পুরোপুরি কাজ শেষ করা যায় না।
হাওর আন্দোলনের নেতারা বলছেন, পানি ধীরে নামার অজুহাত পুরোনো। এটা সব সময় বা সব স্থানে হয় না। নভেম্বরের মধ্যে প্রকল্প নির্ধারণ ও পিআইসি গঠনের কাজ করার কথা। কিন্তু এই কাজ চলে জানুয়ারি পর্যন্ত।
এদিকে নীতিমালা অনুযায়ী কাজের শুরুতে পিআইসিগুলো ২৫ ভাগ টাকা পায়। পরে তিন কিস্তিতে বাকি টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় কিস্তির টাকাই পায়নি অনেক পিআইসি। এতে প্রকল্প–সংশ্লিষ্টরা কাজে আগ্রহ পান না। মধ্যনগর উপজেলার গুরমার হাওরের ২৪ নম্বর প্রকল্পের সভাপতি পিন্টু তালুকদার বলেন, ‘বৃষ্টিতে কাজে সমস্যা হয়েছে। আবার সময়মতো টাকাও পাইনি।’
তদারকিতে গাফিলতির অভিযোগ
সময়মতো বাঁধের কাজ শেষ না হওয়ার প্রতিবাদে গত বৃহস্পতিবার জেলা শহরে হাওর বাঁচাও আন্দোলনের ব্যানারে সমাবেশ হয়েছে। সেখানে বক্তারা বলেন, ৯৫ ভাগ কাজ শেষের দাবি করা হলেও মাঠের অবস্থা ভিন্ন। এখন পর্যন্ত ৬০ ভাগ কাজ হয়েছে। এখন বৃষ্টি হলেই ফসল ঝুঁকিতে পড়বে। নানাভাবে বলার পরও বাঁধের কাজে গতি বাড়েনি। এতে সবার অবহেলা ও গাফিলতি আছে।
কাজ শেষ না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সুনামগঞ্জ সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) সদস্যরা। গতকাল সনাকের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সুনামগঞ্জের কৃষকেরা হাওরের বোরো ফসলের ওপর নির্ভরশীল। কোনো কারণে এই ফসল গোলায় না তুলতে পারলে কৃষক পরিবারে কষ্টের সীমা থাকে না। বিভিন্ন সময়ে ওঠা অনিয়ম ও গাফিলতির অভিযোগ খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে প্রায় প্রতিবছর বাঁধের কাজে এমনটি হতো না।