১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি, শুক্রবার। স্বদেশি আন্দোলনের তৎকালীন যুব কংগ্রেসের তরুণ নেতা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে সলঙ্গা হাটে বিলেতি পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন কিছু কর্মী। ব্রিটিশ পুলিশ হঠাৎ করেই ওই হাটের কংগ্রেস অফিস থেকে গ্রেপ্তার করে আবদুর রশীদ তর্কবাগীশকে। তাঁকে মুক্ত করতে চেষ্টা করেন হাটে আসা হাজারো মানুষ। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন কয়েক শ মানুষ। সেদিন আহত হয়েছিলেন কয়েক হাজার। মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের লেখা স্বাধীনতা সংগ্রামের রক্তসিঁড়ি সলঙ্গা শীর্ষক রচনায় ঐতিহাসিক এ ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
ঘটনার ১০০ বছর পার হলেও ওই গণহত্যার স্মৃতি রক্ষায় নির্মাণ করা হয়নি কোনো স্মৃতিস্তম্ভ বা নিহত ব্যক্তিদের নামফলক। ফলে হারিয়ে যেতে বসেছে এক গণহত্যার স্মৃতি। তৎকালীন পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার অন্তর্গত রায়গঞ্জ থানার একটি উল্লেখযোগ্য হাট ছিল সলঙ্গা। হাটটি ঘুড়কা ইউনিয়নে অবস্থিত।
বর্তমানে সলঙ্গায় বৃহস্পতিবার বড় হাট ও সোমবার ছোট হাটবার। গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে সলঙ্গায় গো-হাটায় গিয়ে দেখা যায়, পুরো জায়গা ফাঁকা পড়ে আছে। গাছের গুঁড়ির ওপর বসে চা পান করছিলেন তিনজন হাঁটুরে। তাঁরা জানালেন, বৃহস্পতিবার হাটে গরু ওঠে না। সোমবার হাটে গরু ওঠে। তবে নানা কারণে এই গরুহাটার সেই জৌলুশ আর নেই। ব্রিটিশ আমলে এখানকার গণহত্যার কথা তাঁরা শুনলেও বেশি কিছু জানেন না।
সেখানে কথা হয় সলঙ্গা বাজার এলাকার বাসিন্দা সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুস সামাদের (৭১) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘লোকমুখে ও স্থানীয় মানুষদের উদ্যোগে প্রকাশিত পত্রিকায় সলঙ্গা গরুর হাটে সংঘটিত গণহত্যার কথা জেনেছি। ঐতিহাসিক এ ঘটনা স্মরণে এখানে কোনো স্মৃতিফলক বা স্থাপনা নেই। এভাবে চলতে থাকলে একসময় বিষয়টি মানুষ ভুলে যেতে পারে।’
সামনে এগিয়ে গিয়ে একটি দোকানে কথা হয় সলঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক জালাল উদ্দীনের সঙ্গে। তিনি বলেন, তাঁর দাদা নইমুদ্দিনের কাছে সেদিনের বিভীষিকাময় ঘটনার বর্ণনা শুনেছেন। হাটের কয়েক কিলোমিটার দূরের বনবাড়িয়া গ্রামে তাঁর দাদার বাড়ি। সেদিন হাটে তাঁর দাদা এসেছিলেন। তিনি ছিলেন গ্রামের প্রধানদের একজন ছিলেন। দাদার উদ্ধৃতি দিয়ে জালাল উদ্দীন বলেন, ‘স্বদেশি আন্দোলনের কর্মীদের সঙ্গে ইংরেজ পুলিশের তর্কাতর্কি চলতে থাকে। এমন সময় তর্কবাগীশ সাহেবকে গ্রেপ্তার করে নির্মম নির্যাতন করা হয়। হাটে ছড়িয়ে পড়ে যে মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ নির্যাতনে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছেন। কেউ কেউ রটিয়ে দেন, তিনি মারা গেছেন। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ইংরেজ পুলিশের গুলিতে নিহত হন কয়েক শ মানুষ। আহত হন হাজারো মানুষ।’ এ বিষয়ে হাটে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের ভিত্তিপ্রস্তর ছাড়া আর কিছু নেই বলে তিনি জানান।
ভিত্তিপ্রস্তরটির কাছে গিয়ে দেখা যায়, ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারি তখনকার স্থানীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নান তালুকদার এটি উদ্বোধন করেন।
সলঙ্গা বাজার এলাকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন সরকারের সঙ্গে কথা হয় থানা মসজিদের সামনে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা মরহুম আবদুল গণি সরকার ছিলেন শতবর্ষী মানুষ ও ঘুড়কা ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান। তাঁর কাছে শুনেছি, সেদিনের নারকীয় তাণ্ডবের কথা। নিহত ও আহত ব্যক্তিদের মহিষের গাড়িতে বেঁধে সিরাজগঞ্জের দিকে নেওয়া হয়েছিল। ভয়ে তাঁদের পরিবারের লোকজন এসব কথা কখনো বলেননি। ফলে সলঙ্গা গণহত্যার শিকার ব্যক্তিদের সম্পর্কে বেশি কিছু জানা যায়নি।’
রায়গঞ্জের ইউএনও মোহাম্মদ নাহিদ হাসান খান শুক্রবার বলেন, ‘এখানে অল্প দিন হলো এসেছি। সলঙ্গা গণহত্যা দিবস ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণে ভিত্তিপ্রস্তর বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’