থামল জাতীয় সংগীত। শুরু হলো ধান কাটা। ৯ নারীর হাতে ৯টি কাঁচি যেন ধানখেতে ঝড় তুলে দিল। ১০ মিনিট ১২ সেকেন্ডে রেখা কুজুর দল ২৯৪টি ধানের গোছা কেটে প্রথম স্থান অধিকার করল। তখন চারদিকে মানুষের মুহুর্মুহু করতালি। এভাবেই রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার চৈতন্যপুর গ্রামে আজ শনিবার বিকেলে শুরু হয় নবান্ন উৎসব। আর গ্রামজুড়ে মানুষের মধ্যে যেন ছড়িয়ে পড়ে আনন্দের বন্যা।
ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী অধ্যুষিত এই গ্রামের আবহমান এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চৈতন্যপুর গ্রামে জাতীয় কৃষি পদকপ্রাপ্ত কৃষক মনিরুজ্জামান আয়োজন করেছেন নবান্ন উৎসবের। পয়লা অগ্রহায়ণে গ্রামের সবাইকে নিয়ে তিনি আয়োজন করেন বাঙালি ঐতিহ্যের এই উৎসবের। এবার নিয়ে ষষ্ঠ বছরের মতো এ গ্রামে নবান্ন উৎসবের আয়োজন করা হলো।
উৎসব উপলক্ষে চৈতন্যপুর গ্রামের মাঠে ধান কাটার এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। তারপর ছিল নাচগান, খেলাধুলা এবং এর ফাঁকে ফাঁকে অতিথিদের বক্তব্য। এ উৎসব উপলক্ষে কৃষকের বাড়িতে বাড়িতে এদিন ভালো খাবার রান্না করা হয়। এবারও সকাল সকাল বাড়ির কাজ সেরে বিকেল চারটার মধ্যে সবাই চলে আসেন মাঠে। শুরুতেই ধান কাটার প্রতিযোগিতায় নামে কিষানিদের তিনটি দল। প্রতিটি দলে তিনজন করে কিষানি। একটি দলে ছিলেন ফর্সাপাড়া গ্রামের রেখা কুজুর, স্বপ্ন লাকড়া, উরিনা লাকড়া; আরেকটি দলে কান্তপাশা গ্রামের সুচি মিনজ, রোজিনা টপ্পো, মামনি তির্কি এবং আরেকটি দলে ফর্সাপাড়া গ্রামের বিমলা বেগ, ঝিনুক মালা ও চম্পা খাঁ খাঁ। প্রতিটি দলকে লম্বালম্বি ২১ গোছা ও চওড়ায় ১৪ গোছা ধান কাটতে হয়। মোট ধানের গোছা হয় ২৯৪টি। প্রথম হওয়া রেখা কুজুরের দল ১০ মিনিট ১২ সেকেন্ডে সব ধান কেটে শেষ করে। দ্বিতীয় হওয়া কান্তপাশা গ্রামের দলটি সময় নেয় ১০ মিনিট ৪৮ সেকেন্ড। আর তৃতীয় হওয়া ফর্সাপাড়া গ্রামের অপর দলটি সময় নেয় ১১ মিনিট। অনুষ্ঠান শেষে প্রথম হওয়া তিন নারীকে পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয় শাড়ি। অন্য দুই দলের ছয় নারী পুরস্কার হিসেবে পান একটি করে গামছা।
কৃষিক্ষেত্রে ভালো অবদান রয়েছে, এমন ব্যক্তিকে প্রতিবছরই এ অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে আনা হয়। এবার এসেছিলেন রাজশাহীর তানোরের স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী ও জাতীয় কৃষি পুরস্কারপ্রাপ্ত কৃষক নূর মোহাম্মদ, অসহায় মানুষকে বিনা মূল্যে ভেষজ চিকিৎসা দেওয়া বগুড়ার কাহালুর আবদুল কাদের খান এবং নওগাঁর শাহ কৃষি তথ্য পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা জাহাঙ্গীর আলম শাহ। ছিলেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট রাজশাহীর ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সাখাওয়াত হোসেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মরিয়ম খাতুন ও সাংবাদিক আবু সালেহ মো. ফাত্তা।
স্বশিক্ষিত কৃষিবিজ্ঞানী নূর মোহাম্মদ বলেন, ‘এই নবান্ন উৎসব কৃষকের সারা বছরের ক্লান্তি দূর করে দেয়। এমন আয়োজন এখন কমে গেলেও চৈতন্যপুর গ্রামে নতুন মাত্রা পেয়েছে কৃষক মনিরুজ্জামানের কারণে।’
আবদুল কাদের খান বললেন, তিনি জীবনে প্রথমবার এ ধরনের অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন। সবার কাছে তাঁর একটাই বার্তা, সপ্তাহের সাত দিনে অন্তত ১৪ ধরনের সবজি খেতে হবে। তাহলেই সবাই সুস্থ থাকবেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক উম্মে ছালমা বলেন, ‘নবান্ন উৎসব আমাদের কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে মিশে আছে। একসময় আমরা কার্তিককে মরা কার্তিক হিসেবে জানতাম। সেই মরা কার্তিক এখন আর নেই। কার্তিক শেষ, অগ্রহায়ণের শুরু এই সময়ে নতুন আমন ধান কাটা শুরু হয়েছে। কৃষকের ঘরে ঘরে আমন ধান উঠছে। এই সময়ে নবান্নের উৎসব আমরা খুব উপভোগ করি।’
উৎসবের আয়োজক মনিরুজ্জামান মনিরের বাড়ি রাজশাহী নগরের মহিষবাথান এলাকায়। উচ্চশিক্ষিত এই কৃষক চৈতন্যপুর গ্রামে চাষাবাদে নামেন প্রায় এক যুগ আগে। ফল-ফসল চাষের মাধ্যমে কৃষিতে বৈচিত্র্য এনে তিনি সফলতা পেয়েছেন। স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি যে একজন কৃষক সারা বছরই সমস্যায় থাকেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে চাষাবাদ করেও তাঁরা ভালো লাভ করতে পারেন না। তাঁদের প্রতিকূল সময়ের সঙ্গে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। তাই বছরের একটা দিন নির্মল আনন্দ দিতেই আমি এ আয়োজন করছি।’