নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে পিরোজপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে সংঘর্ষে তরুণের মৃত্যুর ঘটনায় আজ সোমবার সকাল পর্যন্ত কেউ গ্রেপ্তার হননি। ওই ঘটনায় দুটি মামলার পর গ্রেপ্তার–আতঙ্কে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন গ্রামের পুরুষ সদস্যরা।
গতকাল রোববার বিকেলে নিহত হৃদয় ভূঁইয়ার (২৪) বড় ভাই ইকবাল হোসেন ভূঁইয়া বাদী হয়ে সোনারগাঁ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় নির্বাচনে সদ্য বিজয়ী ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ সরকারসহ ২১ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত আরও এক শ থেকে দেড় শ জনকে। এ ছাড়া ফলাফল ঘোষণার পর পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা করেছে। এই মামলায় অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
আজ সকালে সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এস এম কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, মামলার আসামিরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। তাঁদের ধরতে পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে। পাশাপাশি এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
মেঘনা নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা দুধঘাটা সোনারগাঁর শান্ত জনপদগুলোর একটি। একসময়ের কৃষি অধ্যুষিত দুধঘাটার অধিকাংশ মানুষ এখন মেঘনা নদীর জেলে কিংবা প্রবাসী। শনিবার শান্ত গ্রামটির উপনির্বাচনের ভোট গ্রহণও ছিল শান্তিপূর্ণ।
নারায়ণগঞ্জের পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা রাসেল ও ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর সোনারগাঁয়ের পিরোজপুর ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মুজিবুর রহমানের মৃত্যু হলে গত শনিবার শূন্য পদে উপনির্বাচন হয়। নির্বাচনে এলাকায় যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত কায়সার আহম্মেদ (তালা) ও আবদুল আজিজ সরকার নির্বাচন করেন। দুধঘাটা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট গ্রহণের পর দেখা যায়, কায়সার নির্বাচনে পরাজিত হয়েছেন। কায়সার ফলাফল মেনে নিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হলেও কেন্দ্রের বাইরে থাকা তাঁর সমর্থকেরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। প্রিসাইডিং ও সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা ব্যালট নিয়ে কেন্দ্র থেকে বের হওয়ার সময় কায়সারের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁদের ওপর হামলা করে ব্যালট ছিনিয়ে নেন। হামলায় সেখানে থাকা পুলিশ সদস্যরাও আহত হন। এ সময় পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে রাবার বুলেট ও শটগানের গুলি ছোড়ে।
ঘটনার পর পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘পুলিশ আত্মরক্ষায় দুটি ফাঁকা গুলি ছোড়ে। সংঘর্ষের পর দেখা যায়, দুই তরুণ গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে হাসপাতালে নিয়ে গেলে গুলিবিদ্ধ একজনের মৃত্যু হয়।’
রবি ও সোমবার সকালে ঘটনার কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শীর সঙ্গে প্রথম আলোর কথা হয়েছে। তাঁরা পরিচয় গোপন রাখার শর্তে বলেন, সংঘর্ষের সময় পুলিশ গুলি ছোড়ে এবং লাঠিপেটা করে। তখনই হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাই ওমর ফারুক গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
গতকাল বিকেলে স্থানীয় এক তরুণ ঘটনার সময় করা একটি ভিডিও প্রতিবেদককে দেখান। ভিডিওটিতে দেখা যায়, গুলিবিদ্ধ হৃদয় ভূঁইয়াকে নিয়ে কয়েকজন দৌড়ে হাসপাতালের উদ্দেশে যাচ্ছেন। এ সময় নিজেকে হৃদয়ের ভাই পরিচয় দেওয়া একজন যুবক বলছেন, ‘হৃদয়রে পুলিশ গুলি করছে।’
তবে এ ঘটনায় করা মামলায় বলা হয়েছে, নির্বাচনে সদ্য বিজয়ী ইউপি সদস্য আবদুল আজিজ সরকার তাঁর লোকজন নিয়ে হৃদয় ও তাঁর চাচাতো ভাইকে গুলি করেছেন।
গতকাল নারায়ণগঞ্জ ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ময়নাতদন্তের পর বিকেলে হৃদয় ভূঁইয়ার লাশ তাঁর গ্রামে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয় কবরস্থানে দাফনের আগে হওয়া জানাজায় তাঁর স্বজনেরা বারবার দাবি করেছেন, সংঘর্ষের সময় আবদুল আজিজের লোকজনের ছোড়া গুলিতে হৃদয় নিহত হয়েছেন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে আবদুল আজিজ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পর আমি লোকজন নিয়ে আনন্দ মিছিল করে বাড়িতে চলে যাই। তখনই হইহুল্লোড় শুনি। পরে জানতে পারি, পরাজিত প্রার্থীর লোকজন পুলিশের ওপর হামলা করে ব্যালট ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি ছোড়ে।’ রাজনৈতিক কারণে এখন এ ঘটনায় তাঁকে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘পুলিশ ফাঁকা গুলি ছোড়ে। পুলিশের গুলিতে কেউ নিহত হওয়ার কথা না। নিহত যুবকের স্বজনদের দাবি, প্রতিপক্ষ গুলি করেছে। লাশের ময়নাতদন্ত হয়েছে। ওই তরুণ কার গুলিতে নিহত হয়েছেন, তা তদন্তেই জানা যাবে।’
সংঘর্ষে একজনের মৃত্যু ও দুটি মামলায় প্রায় সাড়ে তিন শ গ্রামবাসীকে আসামি করার পর পুরো গ্রামেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। গ্রামটির অধিকাংশ পুরুষই এখন বাড়িছাড়া। আজ সকালেও দুধঘাটা গ্রামের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সতর্ক অবস্থান দেখা গেছে। সোনারগাঁ থানার ওসি বলেন, সংঘর্ষে কায়সারের এক সমর্থক নিহত হওয়ার পর এখন আবদুল আজিজের বাড়িঘরে হামলার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। পুলিশ এ কারণে সতর্ক অবস্থান নিয়েছে।
দুধঘাটা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নূর সালমা প্রথম আলোকে বলেন, শনিবার বিদ্যালয়ের সামনে সংঘর্ষের পর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা আতঙ্কিত। গতকাল দুটি মামলার পর গ্রেপ্তার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। আজ হাতে গোনা দু-একজন শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে এসেছে।
আজ ওই এলাকার অন্তত তিনটি বাড়িতে কথা বলতে গেলে বাড়ির নারীরা কথা বলতে চাননি। তাঁরা বলছেন, দুটি মামলায় তিন শতাধিক লোক অজ্ঞাত আসামি। পুলিশ কোন মামলায় কাকে গ্রেপ্তার দেখায়, সেই ভয় গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। বাড়ির কিশোর, তরুণ ও পুরুষেরা বাড়ি ছাড়লেও বাড়িঘর দেখভালের জন্য শিশু ও নারীরা আছেন। তবে তাঁরা সংঘর্ষের বিষয়ে কথা বলে নিজেদের বিপদ বাড়াতে চান না।