সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানায় ঢুকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের এক চেয়ারম্যান প্রার্থীকে পিটিয়েছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা। এ ঘটনার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
গত বুধবার দিবাগত মধ্যরাতের এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ওই রাতেই একটি মামলা করেছে। এতে স্থানীয় সংসদ সদস্য (এমপি) আবদুল মোমিন মণ্ডলের কর্মী আবু তালেবকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। তবে হামলার শিকার প্রার্থীর মামলা নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে।
হামলার শিকার প্রার্থীর নাম বদিউজ্জামান ফকির। তিনি মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে বেলকুচি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তিনি জেলার এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের অর্থবিষয়ক সম্পাদক পদে রয়েছেন। হামলাকারী দলের নেতৃত্ব নিচ্ছেন দোয়াত-কলম প্রতীকের চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিনুল ইসলাম। আমিনুল বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা। তিনি সিরাজগঞ্জ-৫ (বেলকুচি-চৌহালী) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মোমিন মণ্ডলের সমর্থিত চেয়ারম্যান প্রার্থী বলে নিজেকে প্রচার করছেন।
এ বিষয়ে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শহিদুল ইসলাম আজ শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এ–সংক্রান্ত একটি অভিযোগ আজই হাতে পেয়েছি। অভিযোগের ভিত্তিতে চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিনুল ইসলামকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে আগামী দুই দিনের মধ্যে নোটিশের জবাব দিতে বলা হয়েছে। অন্যথায় তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
বেলকুচি উপজেলা পরিষদ নির্বাচন প্রথম ধাপে ৮ মে অনুষ্ঠিত হবে। এখানে চেয়ারম্যান পদে তিনজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা বদিউজ্জামান ফকির ও আমিনুল ইসলামের মধ্যে হবে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা বলছেন।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, থানার ভেতরে ঢুকে পুলিশের সামনেই চেয়ারম্যান প্রার্থী বদিউজ্জামান ফকির ও তাঁর সমর্থকদের পেটাচ্ছেন, লাঞ্ছিত করছেন, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করছেন ও হুমকি দিচ্ছেন হামলাকারীরা। থানায় নীরব দর্শকের ভূমিকায় থাকা পুলিশের সামনেই চেয়ারম্যান প্রার্থী বদিউজ্জামান ফকিরকে মারধর ও অপদস্থ করা হচ্ছে। কেউ কেউ ওই প্রার্থীকে থানা থেকে বাইরে নিয়ে পেটানোর হুংকার ছাড়ছেন। বদিউজ্জামানের বাড়িতেও হামলা করবেন বলে হুমকি দিচ্ছেন তাঁরা।
স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, আমিনুল ডিপ্লোমা পাস করে স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য ও মণ্ডল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবদুল মমিন মণ্ডলের শিল্পপ্রতিষ্ঠানে মহাব্যবস্থাপক (জিএম) হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আবদুল মমিন মণ্ডলের নির্বাচনী প্রচার ক্যাম্পের প্রধান ছিলেন তিনি। এখন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে সংসদ সদস্যের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা পাচ্ছেন আমিনুল ইসলাম।
চেয়ারম্যান প্রার্থী বদিউজ্জামান ফকির অভিযোগ করেন, ভোটের আগেই তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আমিনুল ইসলাম তাঁকে মাঠছাড়া করতে এমনটি করে যাচ্ছেন। প্রচারে বাধা দিচ্ছেন। থানা ঘেরাও করে এবার পেটালেন পুলিশের সামনেই। এত কিছুর পরও মামলায় কোথাও তাঁর কোনো নাম নেই। কারণ তিনি সংসদ সদস্যের লোক।
বদিউজ্জামান ফকির অভিযোগ করেন, ২২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করে পুলিশ মামলা করে। ভোররাতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এই ঘটনার মূল হোতা আমিনুল ইসলামের নাম নেই এই নামের তালিকায়।
বদিউজ্জামান ফকির হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, গত বুধবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে নির্বাচনী প্রচার শেষে মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে কজন সমর্থকের সঙ্গে ফিরছিলেন তিনি। পথে পৌর এলাকার চালা সাতরাস্তা মোড়ে তাঁদের গতি রোধ করেন আমিনুলের অনুসারীরা। এ সময় তাঁদের ব্যাপক মারধর ও লাঞ্ছিত করা হয়। তিনি নিজে ও আরও তিন সমর্থক আহত হন। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ দিতে ও নিরাপত্তা চাইতে থানায় যান তিনি। খবর পেয়ে থানার ভেতরে দলবল নিয়ে ছুটে আসেন আমিনুল। ওই দিন রাত সোয়া ১১টার দিকে ঘেরাও করেন বেলকুচি থানা। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্যের চাচাতো ভাই জুবায়ের মণ্ডল, আলীম মণ্ডল, সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত সহকারী (পিএস) সেলিম সরকারসহ শতাধিক সাঙ্গপাঙ্গ। তাঁরা পুলিশের সামনেই তাঁকেসহ তাঁর সমর্থকদের পেটান, লাঞ্ছিত করেন, অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন ও হুমকি দেন। তাঁরা নানাভাবে চেষ্টা করেন তাঁকে ও তাঁর সমর্থকদের থানার বাইরে নেওয়ার। পরে থানা-পুলিশ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হয়ে জেলা পুলিশকে খবর দেয়। আধা ঘণ্টার মধ্যে ডিবিসহ দেড় শতাধিক অতিরিক্ত পুলিশ এসে আমিনুল ও তাঁর বাহিনীকে শান্ত করে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়।
বদিউজ্জামান ফকির অভিযোগ করেন, ‘ভয়ে রাত ৪টা পর্যন্ত থানা থেকে বের হতে পারি নাই। ভোররাতে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেয় ডিবি পুলিশ। এসব ঘটনায় আমিনুলের নামে থানায় লিখিত অভিযোগ দিলেও আমলে নেয়নি পুলিশ।’ বদিউজ্জামান আরও বলেন, এ ঘটনায় থানায় হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে ২২ জনের নাম উল্লেখ ও অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫-২০ জনকে আসামি করে ওই রাতেই পুলিশ মামলা করে। ভোররাতে অভিযান চালিয়ে ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এই ঘটনার মূল হোতা আমিনুল ইসলামের নাম নেই এই নামের তালিকায়।
অভিযোগের বিষয়ে চেয়ারম্যান প্রার্থী আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমি প্রচারণা শেষে ফেরার সময় প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী বদি ফকিরের লোকজন আমাদের ওপর হামলা করে। এ বিষয়ে থানায় অভিযোগ করতে গেলে সেখানে তারা আমাদের ওপর চড়াও হয়। এরই একপর্যায়ে থানার অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটনা ঘটেছে।’ সংসদ সদস্যের ছত্রচ্ছায়ার বিষয়ে প্রশ্ন করলে আমিনুল বলেন, ‘এমপির চাচাতো ভাই ও এপিএস আমার বন্ধু। সেই কারণে তারা আমাকে নির্বাচনে সহায়তা করছে। এই নির্বাচনে এমপি সাহেবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’
বেলকুচি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনিছুর রহমান বলেন, এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার আরিফুর রহমান মণ্ডল বলেন, ভিডিও ফুটেজ দেখে থানার ওই ঘটনায় আরও যাঁদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাবে, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে সিরাজগঞ্জ-৫ আসনের সংসদ সদস্য আবদুল মমিন মণ্ডলের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। খুদে বার্তা পাঠিয়েও তাঁর সাড়া পাওয়া যায়নি।
তবে বেলকুচির পৌর মেয়র ও উপজেলা যুবলীগের সাবেক আহ্বায়ক সাজ্জাদুল হক বলেন, গত ১৯ ডিসেম্বর স্থানীয় সংসদ সদস্যের অনুসারী আবদুল মোতালেবের বাড়িতে বোমা বানাতে গিয়ে বিস্ফোরণে একজন নিহত হন। সেই মামলায় একমাত্র আসামি করা সংসদ সদস্য আবদুল মমিনের সমর্থক আবদুল মোতালেবকে। এ ঘটনার সাড়ে চার মাসেও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। বুধবার রাতে থানায় হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে এবার মোতালেবের আরেক ভাই আবু তালেবকে প্রধান আসামি করে মামলা করেছে। ১০ জনকে গ্রেপ্তারও করেছিল। গতকাল বৃহস্পতিবার তাঁরা জামিনে বের হয়ে আবারও বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন।
বেলকুচি উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আশানুর বিশ্বাস বলেন, বর্তমানে স্থানীয় সংসদ সদস্যের সিদ্ধান্তই থানা-পুলিশ বাস্তবায়ন করছে। যে কারণে এই উপজেলায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই দলের নেতা-কর্মীদের ওপর এমন হামলা হচ্ছে।