নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে হাসেম ফুড কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় মালিকপক্ষকে অব্যাহতি দিয়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। যদিও তদন্তে কারখানার মূল নকশা না মানা, শর্ত ভঙ্গ করে অন্য পণ্য উৎপাদন, অনুমতি ছাড়া কারখানা সম্প্রসারণ, অগ্নিনির্বাপণে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না রাখাসহ নানা ধরনের অনিয়ম পেয়েছে সিআইডি। অভিযোগপত্রে কারখানার চার কর্মকর্তা ও সরকারের কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের দুই পরিদর্শককে আসামি করা হয়েছে।
গতকাল রোববার দুপুরে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক মোকছেদুর রহমান ১৩ পৃষ্ঠার এই অভিযোগপত্র দাখিল করেন। ঘটনার দুই বছর এই অভিযোগপত্র দাখিল করা হলো। আসামিদের বিরুদ্ধে অবহেলার দ্বারা মৃত্যু সংঘটের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ধারায় একজন আসামির সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলাটি করা হয়েছিল হত্যা মামলা হিসেবে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন নারায়ণগঞ্জ আদালত পুলিশের পরিদর্শক মো. আসাদুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, হাসেম ফুডে আগুনে পুড়ে ৫৪ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে সিআইডি। আদালতে অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
অভিযোগপত্রে অব্যাহতি পাওয়া এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন হাসেম ফুডের মালিক আবুল হাসেম (৭০), তাঁর চার ছেলে হাসিব বিন হাসেম (৩৯), তারেক ইব্রাহিম (৩৫), তাওশীফ ইব্রাহিম (৩৩) ও তানজীম ইব্রাহিম (২১)। অভিযোগপত্রভুক্ত আসামিরা হলেন—কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহনে শাহ আজাদ (৪৩), উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ (৫৪), সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন (২৬) ও প্রধান প্রকৌশলী (মেকানিক্যাল ও ইলেট্রিক) ওমর ফারুক (৩৮), কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নারায়ণগঞ্জ কার্যালয়ের পরিদর্শক নেছার উদ্দিন (৪০) ও সৈকত মাহমুদ (৩৭)।
দুর্ঘটনাকবলিত ভবনে শ্রমিকদের বের হতে ভেতর ও বাইরে থেকে খোলার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রতিটি ফ্লোর নেট দিয়ে শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সিঁড়িও তালাবদ্ধ ছিল। কারখানায় শ্রমিকদের ফায়ার প্রশিক্ষণ ও ফায়ার কর্মী ছিল না।
২০২১ সালের ৮ জুলাই রূপগঞ্জের হাসেম ফুড কারখানায় আগুনে পুড়ে কর্মকর্তা-শ্রমিকসহ ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ভুলতা পুলিশ ফাঁড়ির পরিদর্শক নাজিম উদ্দিন বাদী হয়ে কারখানার মালিক আবুল হাসেম ও তাঁর চার ছেলেসহ আটজনকে আসামি করে হত্যা মামলা করেন। আবুল হাসেমসহ ছয় আসামি বর্তমানে জামিনে।
এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মোকছেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তার আগে আরও চার কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেছেন। তদন্তে তাদের প্রাপ্ত ফলাফল তিনি নতুন তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে দাখিল করেন। এরপর কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে অবহেলাজনিত মৃত্যুর অভিযোগে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় কারখানার মালিকসহ পাঁচজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মামলার ফলাফল বাদীকে জানানো হয়েছে। মামলায় বাদীসহ ৯১ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে।
মামলার বাদী নাজিম উদ্দিন আহমেদ বর্তমানে চট্টগ্রামে পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) কর্মরত। এ বিষয়ে তিনি মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, মামলার ফলাফলের বিষয়ে তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁকে কিছু জানাননি। এই ঘটনায় কারখানার মালিক দায় এড়াতে পারেন না। এ কারণে হত্যা মামলা হয়েছিল। অভিযোগপত্রে কী আছে, তা দেখে পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা তাঁর দাখিল করা অভিযোগপত্রে কারখানার বিভিন্ন অনিয়মের কথা তুলে ধরেছেন। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩৪ হাজার ৫০০ বর্গফুটের হাসেম ফুড কারখানার মূল নকশায় তিনটি সিঁড়ি থাকলেও নির্মাণকালে দুটি সিঁড়ি রাখা হয়। ২০২০ সালের ২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ম্যাংগো জুস উৎপাদনের জন্য ছাড়পত্র নেওয়া হলেও কারখানায় শর্ত ভঙ্গ করে লাচ্ছা সেমাই, টোস্ট, মুড়ি, ক্যান্ডি, জ্যাম জেলি, আচার, ম্যাংগো বার, সফট ড্রিঙ্ক ইত্যাদি খাবার উৎপাদন হতো। দুই দশমিক ৫৯ একর জমির ছাড়পত্র নেওয়া হলেও অনুমতি ছাড়া নসিলা উৎপাদনের জন্য কারখানা সম্প্রসারণ করা হয়।
কারখানায় পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রাখা হয়নি উল্লেখ করে অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, দুর্ঘটনাকবলিত ভবনে শ্রমিকদের বের হতে ভেতর ও বাইরে থেকে খোলার ব্যবস্থা রাখা হয়নি। প্রতিটি ফ্লোর নেট দিয়ে শ্রমিকদের আবদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। সিঁড়িও তালাবদ্ধ ছিল। কারখানায় শ্রমিকদের ফায়ার প্রশিক্ষণ ও ফায়ার কর্মী ছিল না। দুর্ঘটনাকবলিত ভবনের নিচতলা থেকে ছয়তলা পর্যন্ত প্রতিটি ফ্লোরে দাহ্য পদার্থ মজুত ছিল। সেই দাহ্য পদার্থের সঙ্গে উৎপাদিত মালামাল মজুত করে রাখা হয়েছিল। কারখানার ভবনের ভেতরে মেশিন স্থাপনে দূরত্বের লেআউট প্ল্যান মানা হয়নি। এগজাস্ট ফ্যানও ভবনের ভেতরে রাখা ছিল। নকশা অনুযায়ী কারখানার দক্ষিণ পাশে ২০ ফুট রাস্তা ও পূর্ব পাশে ১০ ফুট এবং পশ্চিম পাশে ২০ ফুট রাস্তা রাখার কথা থাকলেও তা রাখা হয়নি। শিশু আইন অমান্য করে শিশুশ্রমিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আগুনে পোড়া অধিকাংশ মৃতদেহ শিশুর বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়েছে, কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর নিয়মিত কারখানাটি পরিদর্শন করেনি। অথচ কারখানার লাইসেন্স অসাধুভাবে নবায়ন করে গেছেন। প্রতিষ্ঠানের উপমহাপরিদর্শক সৌমেন বড়ুয়া ও পরিদর্শক নেছার উদ্দিন কারখানা পরিদর্শনে উদাসীনতা দায়িত্বে অবহেলার কারণে ৫৪ শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শক শাহ্ আলম যথাযথভাবে কারখানা পরিদর্শন না করে সনদ নবায়ন করেছেন। অবেহলার কারণে ৫৪ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁরা যদি যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করতেন, তাহলে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটত না।
হাসেম ফুডসের মালিক ও তাঁদের নিয়োগতকৃত কর্মকর্তাদের অপরিকল্পনা অব্যবস্থাপনাজনিত কারণে বৈদ্যুতিক গোলযোগে সৃষ্ট আগুন থেকে অগ্নিকাণ্ড ঘটে বলে তদন্তে প্রাথমিকভাবে প্রতীয়মান হয়েছে বলে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
হাসেম ফুড সেন্ট্রাল স্টোরে কম্প্রেসোর মেশিনের গরম বাতাস বের হতে দুটি এগজাস্ট ফ্যান খোলা জায়গায় না লাগিয়ে ফ্লোরের ভেতরে লাগানো ছিল। এগজাস্ট ফ্যানের গরম বাতাস দাহ্য পদার্থের ওপর পরে উত্তপ্ত থাকত। কেব্লের ইনসুলেশন গলে একটা আরেকটার ওপর লেগে ভোল্টেজ কারণে আগুনের স্ফুলিঙ্গ তৈরি হয়ে তা কেব্লের ইনসুলেশনের ওপর পড়ে। একপর্যায়ে আগুন নিচতলার দাহ্য বস্তুর ওপর ধরে যায়। এগজাস্ট ফ্যানের কারণে আগুন ধরে যায়। আগুন সিঁড়ি, লিফট, নিচতলা, থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত কনভয়ের বেল্ট, কেব্ল ডকেট, জানালার কাছে রক্ষিত ফিনিস গুডস, রেজিন, ভোজ্যতেল, প্লাস্টিক, বিভিন্ন ধরনের মালামাল, গুদামের কারণে আগুন নিচতলা থেকে ষষ্ঠতলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, মামলার এজারনামীয় আসামি কারখানার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেন শাহ, উপমহাব্যবস্থাপক মামুনুর রশিদ, সিভিল ইঞ্জিনিয়ার কাম এডমিন সালাউদ্দিন, প্রধান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার ওমর ফারুক ও কলকারখানা প্রতিষ্ঠান পদিরর্শন অধিদপ্তর পরিদর্শক নেছার উদ্দিন ও সৈকত মাহমুদ পেনাল কোডে ৩০৪ (ক) ৩৪ ধারায় (অবহেলাজনিত মৃত্যু) প্রাথমিকভাবে অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে।
তদন্তকালে আবুল হাসেম ও তাঁর চার ছেলের বিরুদ্ধে মামলায় জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্য–প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অভিযোগে বর্ণিত পেনাল কোড ৩০২ (হত্যা)/৩২৩/৩২৪/৩২৫/৩২৬/৩০৭ ধারায় সত্যতা পাওয়া যায়নি। আবুল হাসেম ও তাঁর চার ছেলে বিরুদ্ধে জড়িত থাকার সুনির্দিষ্ট তথ্য–প্রমাণ না পাওয়ায় তাঁদের অব্যাহতি প্রদান করা হলো।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সার্বিক তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা, সাক্ষ্য প্রমাণে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, ভিডিও ফুটেজ, মরদেহ সুরতহাল, ডিএনএ পরীক্ষার প্রতিবেদন, হাসেম ফুডসের দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের দায়িত্বে অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও তুচ্ছতাচ্ছিল্য কার্যকলাপ, উদাসীনতাসহ নিজেদের খুশিমতো কারখানা পরিচালনা করার কারণে এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সৃষ্টি হয়। এতে কারখানা কর্মকর্তা-শ্রমিক ৫১ জন আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। আগুনের ঘটনায় তিনতলা থেকে লাফিয়ে পড়ে মারাত্মক আহত হয়ে তিন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
অভিযোগপত্রের বিষয়ে শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদ (স্কপ) নারায়ণগঞ্জ জেলার সমন্বয়ক হাফিজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ মালিকপক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এই অভিযোগপত্র দাখিল করেছে। এটা অবহেলা নয়, পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। যখন ওই কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে তখন মালিকপক্ষের লোকজন কারখানা তালাবন্ধ করে দিয়েছে। কারখানার মালিক কোনোভাবেই দায় এড়াতে পারেন না।