চট্টগ্রামে এক যুবককে হেফাজতে নিয়ে নির্যাতনের অভিযোগে পাঁচলাইশের সাবেক ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদার ও একই থানার সাবেক উপপরিদর্শক (এসআই) আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। চট্টগ্রামে ডায়ালাইসিসের খরচ বাড়ানোর প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেপ্তারের পর মো. মুস্তাকিম নামের ওই যুবক পুলিশের হেফাজতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছিলেন। ওই ঘটনায় গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন তিনি।
আজ মঙ্গলবার অতিরিক্ত চিফ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সরকার হাসান শাহরিয়ার আদালত মামলাটি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ সুপার (এসপি) পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেন।
ঘটনার শিকার যুবক মো. মুস্তাকিমের পরিবারকে আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে আদালতে নারাজি আবেদন করা হয়েছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। সেখানে আবেদন খারিজ হলে মহানগর দায়রা জজ আদালতে আপিল করা হয়। মহানগর দায়রা জজ এটি শুনানির জন্য আবার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পাঠান। সেখানে শুনানি শেষে বাদীর নারাজি আবেদন গ্রহণ করে পিবিআইতে পুনঃতদন্তের নির্দেশ দেন।
মুস্তাকিমের ৫৫ বছর বয়সী মা নাসরিন আক্তারের দুটি কিডনিই বিকল ছিল। তাঁকে সপ্তাহে তিন দিন ডায়ালাইসিস করাতে হতো। সাত বছর ধরে তিনি এভাবে ডায়ালাইসিস করে বেঁচেছিলেন। তাঁর স্বামী অনেক আগে মারা গেছেন। একমাত্র অবলম্বন ছিল ২২ বছর বয়সী মাদ্রাসাপড়ুয়া ছেলে মুস্তাকিমের টিউশনির টাকাতেই নাসরিনের ডায়ালাইসিসের খরচ চলত। মুস্তাকিমের মা গত বছরের ১৬ জানুয়ারি মারা যান। যে মায়ের জন্য তার এত সংগ্রাম সেই মাকে আর বাঁচাতে পারেননি তিনি।
২০২৩ সালের ১০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডায়ালাইসিস ফি বাড়ানোর প্রতিবাদ করেন মুস্তাকিম। এ ঘটনার পর সেদিনই পাঁচলাইশ থানায় একটি মামলা করে পুলিশ। মামলায় পুলিশের ওপর হামলা ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। মুস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতপরিচয় ৫০ থেকে ৬০ জনকে আসামি করা হয়। ওই মামলায় মুস্তাকিমকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়।
এরপর ১৩ জানুয়ারি প্রথম আলোয় ‘ডায়ালাইসিসের খরচ জোগানো একমাত্র ছেলেটি জেলে, দিশেহারা মা’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন মুস্তাকিমের জামিনের জন্য লড়ে। পাঁচ দিন কারাভোগের পর গত ১৫ জানুয়ারি তিনি জামিনে মুক্তি পান।
জামিনের পর মুস্তাকিমের করা মামলার অভিযোগে বলা হয়, ১০ জানুয়ারি ডায়ালাইসিস ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায় পুলিশ। পরে তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করা হয়। ঘটনার দিন থানায় নেওয়ার পর মুস্তাকিমকে লাঠিপেটা করা হয়। একটি নির্জন কক্ষে আটকে রেখে ওসির নির্দেশে মারধর করেন এএসআই আবদুল আজিজ। অভিযোগে আরও বলা হয়, পুলিশের নির্যাতনে মুস্তাকিমের পায়ের গোড়ালি থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত, শরীরের বিভিন্ন স্থানে লাল দাগ হয়ে যায় । দুই দিন তাঁর প্রস্রাব বন্ধ থাকে। পরে প্রস্রাবের সঙ্গে রক্ত যায়। নির্যাতনের বিষয়টি প্রকাশ না করার জন্য তাঁকে ক্রসফায়ারের হুমকি দেওয়া হয়।
পুলিশি নির্যাতনের ঘটনায় গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলাটি নেওয়ার আবেদন করেছিলেন মুস্তাকিম। পরে মামলাটি পাঁচলাইশ থানার পুলিশকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন আদালত। একই সঙ্গে সিআইডিকে তদন্তের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়। সিআইডি তদন্ত শেষে গত বছরের ১১ মে এই মামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দিয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেন। আদালত তা গ্রহণ করেন। সিআইডির দেওয়া প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন মুস্তাকিম।