বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলারবাইশারী ইউনিয়নের ক্যথোয়াইপাড়ার মারমা সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। সম্প্রতি তোলা
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলারবাইশারী ইউনিয়নের ক্যথোয়াইপাড়ার মারমা সম্প্রদায়ের বাসিন্দারা। সম্প্রতি তোলা

বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি

যেমন আছেন ক্যথোয়াই পাড়ার বাসিন্দারা

পার্বত্য জেলা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার পূর্ব-দক্ষিণ সীমান্তে বাইশারী ইউনিয়নের ১০ হাজার একরের বেশি পাহাড়-টিলা ভূমিজুড়ে তিন শতাধিক রাবার গাছের বাগান। ওই বাগানে শ্রমিকের কাজ করেন কয়েক হাজার চাকমা, মারমা সম্প্রদায়ের লোকজন। ওই পাহাড়ি টিলার ক্যথোয়াইপাড়ার বাসিন্দারাও রাবার বাগানে কাজ করেন। পাড়ায় ২৭টি মারমা পরিবারের বসবাস। সদস্য সংখ্যা ২৩৫ জন। অধিকাংশ নারী শিশু। মুঠোফোনের নেটওয়ার্কবিহীন এই পল্লির বাসিন্দারা নদীভাঙনসহ নানা সমস্যার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। নেই স্বাস্থ্য, শিক্ষার কোনো ব্যবস্থা।

কক্সবাজারের রামুর ঈদগড়-বাইশারী সড়ক ধরে গেলে পৌঁছানো যায় ক্যথোয়াই পাড়ায়। পাড়ার আগে এই সড়কের আধা কিলোমিটারে ইট বিছানো হয়েছে। উন্নয়ন বলতে এটুকুই। দুর্গম এলাকা হওয়ায় বেসরকারি মুঠোফোন কোম্পানির কোনো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ফলে ইন্টারনেট সেবাও বন্ধ আছে।

গত ২৫ নভেম্বর বিকেলে গ্রামের অন্তত ৩০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁদের প্রধান সমস্যা নদীভাঙন ঝুঁকি। গ্রামের বাসিন্দা থোয়াই মংকি মারমা (৫৫) প্রথম আলোকে বলেন, মারমার পাড়ার পূর্বপাশে খুটাখালী নদী। বর্ষা মৌসুমে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে গ্রামের এক পাশের বসতভূমি বিলীন হচ্ছে। গত বর্ষায় গ্রামের ১৫ ফুট ভূমি নদীতে বিলীন হয়েছে। তাতে সাত-আটটি ঘরবাড়ি ঝুঁকিতে পড়েছে। আসন্ন বর্ষার আগে নদীর তীরে স্থায়ী গাইড ওয়াল কিংবা প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ না হলে বেশ কিছু এলাকা বিলীন হয়ে যেতে পারে।

শত বছরের পুরোনো গ্রামটি গড়ে উঠেছে সরকারি খাস জমিতে। এ পর্যন্ত কোনো পরিবার জমির বিপরীতে বন্দোবস্ত পাননি। গ্রামে পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির লাইন টানা হলেও অতিরিক্ত বিদ্যুৎ বিল নিয়ে বাসিন্দাদের মনে অসন্তোষ রয়েছে।

থোয়াই মং মারমা বলেন, আগে প্রতি ঘরে বিদ্যুৎ বিল আসত ১৫০-২৫০ টাকা করে। এখন বিল দিতে হচ্ছে ২০০ থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। দরিদ্র পরিবারের পক্ষে এত বেশি বিল পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

ক্যথোয়াইপাড়ার মাচাঙের ঘর। সম্প্রতি তোলা

বাইশারী ইউনিয়নের সংরক্ষিত-১ ওয়ার্ডের মহিলা ইউপি সদস্য লাচিং মারমা (৪৫) প্রথম আলোকে বলেন, ২০ বছর আগেও এই গ্রামে ৩০টি মারমা পরিবারের বসতি ছিল। এখন ২৭ পরিবারে ২৩৫ জন বসবাস করছেন। মানুষের প্রধান পেশা কৃষি ও রাবার বাগানের শ্রমিকের কাজ। গ্রামে কোনো স্কুল নেই। তিন কিলোমিটার দূরে রামুর ঈদগড় হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে ২০-২৫ জন শিশু পড়াশোনা করছে। আশপাশে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে না থাকায় অনেক শিশু-কিশোর উচ্চশিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

গ্রামের কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী মংক্য চিং মারমা (২৫) প্রথম আলোকে বলেন, দরিদ্র পরিবারের সন্তান হলেও তিনি ২৫ কিলোমিটার দূরে নাইক্ষ্যংছড়ি আবুল কালাম ডিগ্রি কলেজে গিয়ে পড়াশোনা করছেন। বর্তমানে তিনি ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। উচ্চশিক্ষার অভাবে গ্রামের বহু ছেলে মেয়ে বেকার পড়ে আছে। ইন্টারনেট ও মুঠোফোন সংযোগের নেটওয়ার্ক না থাকায় গ্রামের মানুষ দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পান না। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে আছে শিশু-কিশোরেরা। গ্রামের মানুষ সরকারি বেসরকারি সহায়তা থেকেও বঞ্চিত।

বাইশারীর একটি রাবার বাগানের শ্রমিকের কাজ করেন ময়ু মারমা। সারা দিন পরিশ্রম করে যে টাকা আয় করেন, তা দিয়ে সংসার চলে না। তাতে একমাত্র ছেলে লেখাপড়াও বন্ধ হয়ে গেছে।

ময়ু মারমা (৪৫) বলেন, তাঁর ছেলে জজ থোয়াই মারমা (১২) গত বছর ঈদগড় হেডম্যান পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে। কিন্তু ২৫ কিলোমিটার দূরের নাইক্ষ্যংছড়ি সদরের উচ্চবিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। সেই সামর্থ্য তাঁর নেই। ঘরে বসেই অলস সময় পার করছে এই কিশোর।

মারমা পাড়ার চারদিকে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঘরবাড়ি। গ্রামের কিছুটা দূরে পাহাড়চূড়ার মারমাদের ছোট একটি বৌদ্ধবিহার। বিহারের চারপাশে সীমানা নেই। বিহারের অবস্থাও নাজুক। কিন্তু হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট নিয়ে শঙ্কা নেই সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের।

ইউপি সদস্য লাচিং মারমা বলেন, আমরা মুসলিম-বৌদ্ধরা মিলেমিশে থাকি, আপদে বিপদে একে অপরের পাশে দাঁড়াই। সব সময় সম্প্রীতি বজায় রাখার চেষ্টা করি। গত ২০-৩০ বছরে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে মারামারি কিংবা ঝগড়া-ফ্যাসাদের ঘটনাও ঘটেনি।