জাহাজে সাত খুন

বেঁচে থাকা জুয়েলের শ্বাসনালি কেটে গেছে, কিছু বলতে চেয়েও পারছেন না

জাহাজ থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার জুয়েল রানা (৩৫) শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় কথা বলতে পারছেন না। তাই কাগজে লিখে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। আজ সোমবার চাঁদপুর সদর হাসপাতালের সামনে অ্যাম্বুলেন্সে
ছবি: আলম পলাশ

চাঁদপুরের মেঘনায় সারবাহী জাহাজ থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার ফরিদপুরের জুয়েল রানা (৩৫) ঘটনার বিষয়ে নৌ পুলিশকে কিছু একটা বলতে চেয়েছেন; কিন্তু শ্বাসনালি কেটে যাওয়ায় তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। তাই নিজ হাতে লিখে সেটি বলার চেষ্টা করেন। শেষ পর্যন্ত অবস্থা গুরুতর হওয়ায় লেখা শেষের আগেই আজ সোমবার সন্ধ্যায় তাঁকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে চাঁদপুর সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।

চাঁদপুরের হাইমচরের মেঘনা নদীর ঈশানবালা খাল এলাকায় নোঙর করা এমভি আল-বাখেরা নামের একটি জাহাজ থেকে আজ সোমবার বেলা তিনটার পরে পাঁচজনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

চাঁদপুর নৌ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ কে এম ইকবাল বলেন, ‘আমরা আহত জুয়েলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি; কিন্তু তিনি কথা বলতে পারেননি। শুধু একটি কাগজে তাঁর নাম আর একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যান। আর শেষ দিকে “আমি স” লেখার পর অ্যাম্বুলেন্সটি চাঁদপুর থেকে চলে যায়। আমাদের ধারণা, জুয়েল হয়তো কিছু একটা জানেন বলে বলার চেষ্টা করেছেন। তবে এখনো কোনো তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।’

চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মেঘনা নদীর ইশানবালা খালের মুখে নোঙর করা এম ভি আল-বাখেরা নামের একটি সারবাহী নৌযান থেকে মরদেহ উদ্ধার করা হয়

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সন্ধ্যায় চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় বলেন, তাঁরা ওই জাহাজে গিয়ে পাঁচজনকে পাঁচটি কক্ষে রক্তাক্ত অবস্থায় মৃত পান। বাকি তিনজনকে জাহাজের বিভিন্ন স্থানে রক্তাক্ত অবস্থায় জীবিত মনে হওয়ায় দ্রুতই ২৫০ শয্যা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হয়; কিন্তু হাসপাতালে নেওয়ার পর দুজনকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ভাগ্যক্রমে শ্বাসনালি কাটা অবস্থায় জুয়েল নামের একজন স্টাফ এখনো বেঁচে আছেন। তাঁকে উন্নত চিকিৎসা দিতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বলেন, ‘আমরা প্রাথমিক তদন্ত করে বিষয়টি ডাকাতি মনে করছি না। এ ধরনের নৃশংসতম ঘটনা একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড মনে হচ্ছে। কারণ, সেখানে দুটি মোবাইল, মানিব্যাগ ও অন্যান্য জিনিসপত্র অক্ষত পাওয়া যায়।’
চাঁদপুর নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, আজ ভোরে বা সকালের মধ্যে কোনো এক সময়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে তাঁরা ধারণা করছেন। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি মেঘনা নদীর পশ্চিমাংশ চর এলাকায়। দুপুরে খবর পেয়ে নৌ পুলিশের সেখানে পৌঁছাতেও এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। দুর্বৃত্তরা নিরিবিলি এলাকা নিশ্চিত হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে সহজে পালিয়ে যায় বলে ধারণা করছেন।

নিহত সাতজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত করতে চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গে নেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া (৬০), ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন (৫৫), সুকানি আমিনুল মুন্সি (৪০), গ্রিজার সজিবুল (৩৫), আজিজুল (৪০), স্টাফ মাজেদুল ইসলামের পরিচয় পাওয়া যায়।

২৫০ শয্যা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা মো. আনিসুর রহমান বলেন, ‘সবাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এ জন্য একজন ছাড়া বাকিরা রক্তক্ষরণে মারা যান। জুয়েল নামের একজনের শ্বাসনালি কাটার পরও তিনি শ্বাস নিতে পারায় তাঁকে ঢাকায় পাঠানো হয়।’

চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মহসীন উদ্দিন বলেন, ‘এটি একটি বীভৎস হত্যাকাণ্ড ছিল, যা আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। আমরা প্রশাসনের সর্বস্তরের লোকজন খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। বিষয়টি পৃথক পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করছি। কীভাবে, কেন, কারা ঘটাল, আশা করি তদন্তের মাধ্যমে তা বেরিয়ে আসবে।’

আহত জুয়েল রানাকে রাত পৌনে ৯টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়েছে। তাঁকে নাক, কান ও গলা বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। সেখানকার মেডিকেল অফিসার সিরাজ সালেক প্রথম আলোকে বলেন, জুয়েল রানার শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় সেখানে একটি টিউব যুক্ত করা হয়েছে। তিনি এখনো শঙ্কামুক্ত নন।

জুয়েল রানার ভাই সেকেন খালাসী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরে। জুয়েল চার বছর ধরে ওই জাহাজে সুকানির কাজ করছিলেন।