প্রতি বৃহস্পতিবার গরুর হাটের কারণে চুপাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চুপাইর উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ বেহাল হয়ে পড়েছে।
পাশাপাশি দুটি বিদ্যালয়ে পাঠদান চলছিল। বিদ্যালয়গুলোর মাঠে একের পর এক জড়ো করা হচ্ছিল গরুবাহী ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান। মাঠে গরু নামিয়ে নেওয়া হচ্ছিল পাশের হাটে। যানবাহনের শব্দ আর গরুর ব্যবসায়ীদের হাঁকডাকের মধ্যে বেলা দুইটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যালয় দুটিতে বাজানো হয় ছুটির ঘণ্টা।
শিক্ষার্থীরা ট্রাক–পিকআপ ভ্যানের ভিড় ঠেলে বিদ্যালয়ের মাঠ পার হয়। প্রতি বৃহস্পতিবার এমন চিত্র দেখা যায় গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের চুপাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও চুপাইর উচ্চবিদ্যালয় মাঠে।
গরুবাহী ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান পার্কিং করায় এবং গরু ওঠানো–নামানোর কারণে মাঠটি গোবর আর কাদায় ভরে থাকে। ফলে শিক্ষার্থীরা মাঠে খেলাধুলা করতে পারে না। হাটবারের দিন বিদ্যালয়ে ব্যাহত হয় পাঠদান। ক্লাস হয় আধা বেলা।
বৃহস্পতিবার ছেলেকে নিয়ে একটু ভয়ে থাকি। সেদিন স্কুলের মাঠে সকাল থেকেই গরু ওঠানো–নামানো করা হয়। কখন কী বিপদ ঘটে যায়, সেই চিন্তায় থাকতে হয়।তাহমিনা আক্তার, অভিভাবক
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কালীগঞ্জ উপজেলার জামালপুর ইউনিয়নের ৩১১ নম্বর চুপাইর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছে ১৮৮৯ সালে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী আছে। পাশে চুপাইর উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯২৫ সালে। ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী রয়েছে প্রায় ৬০০।
দুই বিদ্যালয়ের একটি মাঠ। মাঠটি অনেক বড়। উচ্চবিদ্যালয়ের জন্য নির্মিত হয়েছে চারতলা ভবন। ওই ভবনে শিক্ষার্থীদের জায়গা না হওয়ায় পাশের পুরোনো একটি ভবনেও ক্লাস হয়। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার দেবনাথ। একই সঙ্গে তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি।
এলাকাবাসী ও অভিভাবকেরা জানান, কালীগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের সভাপতি আলমগীর হোসেনসহ ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় কয়েকজন নেতা চুপারই গরুর হাট ইজারা নিয়ে ব্যবসা করে আসছেন। একসময় গরুর হাট স্কুলের মাঠেই বসানো হতো। বিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের প্রতিবাদের মুখে বিদ্যালয়ের মাঠ থেকে গরুর হাট সরিয়ে পাশের একটি মাঠে বসানো হয়।
কিন্তু গরুর ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে গরু নিয়ে এসে প্রথমে প্রবেশ করে বিদ্যালয়ের মাঠে। সেখানে গরু নামিয়ে তারপর নিয়ে যাওয়া হয় হাটে। আবার ব্যাপারীরা গরু কিনে স্কুলের মাঠে নিয়ে এসে সেখান থেকে ট্রাকে বা পিকআপ ভ্যানে উঠিয়ে গন্তব্যে নিয়ে যান। হাট শেষ হওয়া পর্যন্ত গরুর ট্রাক ও পিকআপগুলো রাখা হয় বিদ্যালয়ের মাঠেই।
হাটবারে সরেজমিনে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের মাঠের বেশির ভাগজুড়েই রাখা হয়েছে গরুবাহী ট্রাক, পিকআপ ভ্যান ও অন্যান্য যানবাহন। পুরো মাঠ কাদামাটি আর গোবরে ছেয়ে গেছে। যানবাহন আর গরুর শব্দে ক্লাসে মনোযোগী হতে পারছিল না শিক্ষার্থীরা।
বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা চুপাইর উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আলী নেওয়াজ বলেন, ‘দেখেন মাঠের কী অবস্থা। মাঠের এমন অবস্থা হলে ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করবে কীভাবে।’ কিছু বলেন না কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা বললে কি আর কাজ হবে?’
গরুর হাটের কারণে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা খুবই ক্ষুব্ধ। উপজেলার নয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী তাহসান হাবিবের মা তাহমিনা আক্তার বলেন, ‘বৃহস্পতিবার ছেলেকে নিয়ে একটু ভয়ে থাকি। সেদিন স্কুলের মাঠে সকাল থেকেই গরু ওঠানো–নামানো করা হয়। কখন কী বিপদ ঘটে যায়, সেই চিন্তায় থাকতে হয়। লেখাপড়ায়ও ব্যাঘাত ঘটে।’
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সবিতা রানী দাস জানান, বৃহস্পতিবার গরুর হাটের কারণে তাঁরা কোনো বিরতি দেন না। সকাল থেকে একটানা ক্লাস করে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া ওই দিন সকাল থেকে স্কুলের পাশ দিয়ে রশি টানিয়ে দেওয়া হয়, যাতে ছেলেমেয়েরা রশির বাইরে অন্যদিকে না যায়।
সাদ্দাম হোসেন নামের একজন ব্যবসায়ী বলেন, স্বপন কুমার দেবনাথ চুপাইর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক, একই সঙ্গে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সভাপতি। তিনি জামালপুর ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও। স্বপন কুমার নিজেও গরুর হাটের অংশীদার হিসেবে আছেন। তাই হাটের কারণে শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা নেই।
এ বিষয়ে গতকাল স্বপন কুমার দেবনাথ মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দলের লোকজন হাটের সঙ্গে জড়িত। তাঁদের ট্রাক রাখতে নিষেধ করলেও শোনেন না। ট্রাক রাখা বন্ধ করতে হলে সীমানাদেয়াল প্রয়োজন। সীমানাদেয়াল করার মতো টাকা নেই।
বিদ্যালয়ের মাঠে গরুর হাটের বিষয়ে অবগত আছেন জানিয়ে কালীগঞ্জ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা নূর-ই–জান্নাত।