সাগর-নদী থেকে ধরে আনা ইলিশ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠানোর জন্য ককশিটে বরফ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে
সাগর-নদী থেকে ধরে আনা ইলিশ দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠানোর জন্য ককশিটে বরফ দিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হচ্ছে। বরগুনার পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রে

মধ্যবিত্তের আক্ষেপ নিয়েই শেষ হচ্ছে ইলিশের মৌসুম

সাধারণ ক্রেতাদের আক্ষেপ নিয়েই এবার শেষ হতে চলেছে ইলিশের মৌসুম। মাত্র দুই দিন পরই শুরু হবে প্রজনন মৌসুমে মা ইলিশ সুরক্ষায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্য দিয়ে শেষ হবে এবারের মৌসুম।

১৩ অক্টোবরের নিষেধাজ্ঞা ঘিরে বরিশাল অঞ্চলের পাইকারি ও খুচরা বাজারে আরেক দফা বেড়েছে ইলিশের দাম। পাল্লা দিয়ে কমেছে ইলিশের আহরণ। মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মানুষের ডাল-ভাতেই যখন টানাপোড়েন, তখন মৌসুমজুড়েই আকাশচুম্বী দামের ইলিশ মধ্যবিত্তের পাতে ওঠেনি।

গতকাল বুধবার বরিশালের বাংলাবাজার ঘুরে দেখা যায়, সামান্য কিছু ইলিশ এসেছে বাজারে। ক্রেতাদের ভিড় আছে। তাঁদের কেউ দাম করছেন, কেউ আবার ইলিশের চেহারা দেখছেন। দাম শুনেই কেউ কেউ মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। বাজারে ছোট-বড় কয়েকটি ইলিশ নিয়ে বসেছিলেন মাছ বিক্রেতা জয়নাল। আকারভেদে দাম কেজিপ্রতি ১ হাজার ২০০ থেকে ২ হাজার ২০০ টাকা। একজন ক্রেতা ছোট এক জোড়া ইলিশের দাম করতেই পাল্লায় ওজন দিয়ে জয়নাল বললেন, ‘১ কেজি ১৫০ গ্রাম। আমনের দাম অইছে ১৩ শ ৮৯ টাহা।’ ক্রেতা কিছু না বলেই নীরবে হাঁটতে শুরু করলেন। পেছন থেকে জয়নাল ডাকলেও তিনি ভ্রুক্ষেপ করলেন না।

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা ওই ক্রেতা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাচ্চারা অনেক দিন ধরে ইলিশ খেতে চায়। নিজেরও খেতে ইচ্ছা করে। বাসায় শাশুড়ি বেড়াতে এসেছেন। ভেবেছিলাম, এই অসিলায় যদি ইলিশ খেতে পারি। কিন্তু ছোট ইলিশের দাম শুনে মাথা ঘুরে গেল। এত দাম দিয়ে ইলিশ কিনব কীভাবে? কয়টা টাকাই–বা রোজগার করি…।’

ইলিশের মৌসুমে দাম কমবে, এই আশায় দেশের সব শ্রেণির মানুষ অপেক্ষায় থাকেন। এ সময়ে পরিবারের সবার পাতে অন্তত এক বেলা ইলিশ তুলে দিতে চান। কিন্তু এবার অস্বাভাবিক দামের কারণে তা-ও সম্ভব হয়নি। এ নিয়ে মানুষের আক্ষেপের শেষ নেই। নানা মাধ্যমে ক্ষোভও প্রকাশ পাচ্ছে।

ক্রেতাদের প্রশ্ন, প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া ইলিশের আকাশচুম্বী দাম কেন? এর পেছনে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। তবে দাম বাড়ার পেছনে বরিশাল অঞ্চলের জেলে, মৎস্য বিশেষজ্ঞ ও ভোক্তা অধিকারের কর্মকর্তারা বলছেন, ইলিশ ধরা থেকে বাজারজাতের ধাপগুলোয় তদারকি সংস্থার দুর্বলতার কারণে শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। সিন্ডিকেটের কারসাজিতেই ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) বরিশাল জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রনজিৎ দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সাধারণ মানুষ ইলিশ খেতে পারবেন না, এটা সোজা কথা। এখন এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে রাষ্ট্রকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আমরা চিৎকার করছি। কিন্তু তাতে কোনো সুরাহা হচ্ছে না। এভাবে নির্লিপ্ত হলে আমরা তো অসহায় হয়ে যাই।’ তিনি বলেন, ইলিশের আহরণ থেকে খুচরা ক্রেতার হাত পর্যন্ত পৌঁছাতে চার থেকে পাঁচজনের হাতবদল হয়। যতবার হাতবদল, ততবার দাম বাড়ে। এটি এক আজব চক্র। চক্র না ভাঙলে কখনো সাধারণ মানুষ ইলিশের নাগাল পাবেন না।

আরেক দফা দাম বৃদ্ধি

আজ বৃহস্পতিবার বরিশালের পাইকারি ইলিশ মোকাম পোর্ট রোডে দেখা যায়, ইলিশের আমদানি খুবই কম। আগে এ সময়ে এক থেকে দেড় হাজার মণ ইলিশ আসত। সেখানে আজ ২০০ মণের মতো ইলিশ এসেছে। এর মধ্যে ১৭৫ মণই জাটকা বা তার চেয়ে একটু বড় আকারের। বাকি ২৫ মণ বড় ইলিশ। দাম আগের চেয়ে আরও বেড়েছে।

মোকামের আড়তদার আশরাফ আলী জানান, এক কেজি ওজনের ইলিশ আজ পাইকারি প্রতি মণ ৮৭ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ৭০০ থেকে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭৮ হাজার টাকা ও ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৯৫ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে। এ ছাড়া চার থেকে ছয়টিতে এক কেজি হয়, এমন ইলিশ মণপ্রতি ২৮ থেকে ৩৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। তিনি বলেন, ইলিশের দাম সপ্তাহখানেক আগে মণপ্রতি ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা কম ছিল।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মৎস্যকেন্দ্র বরগুনার পাথরঘাটায় বিএফডিসি অবতরণকেন্দ্রেও মৌসুমের শেষে চড়া দামে ইলিশ বিক্রি হয়েছে। এক কেজি বা তার চেয়ে বেশি ওজনের ইলিশ ৮০ থেকে ৮৮ হাজার টাকা মণ, ৮০০ গ্রাম থেকে সাড়ে ৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৭৪ থেকে ৭৭ হাজার, ৬০০ গ্রাম থেকে সাড়ে ৭০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৬১ থেকে ৬৫ হাজার ও ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা মণ বিক্রি হয়েছে।

পাথরঘাটা মৎস্য অবতরণকেন্দ্রের সহকারী বিপণন কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল এ বছরের সবচেয়ে বেশি দামে ইলিশ বিক্রি হয়েছে। আজও তা অব্যাহত ছিল। ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাছের সরবরাহ কম ও পূজা থাকায় দাম বেড়েছে।

মধ্যবিত্তের স্মৃতির জাদুঘরে ইলিশ

প্রাগৈতিহাসিক ও পৌরাণিক যুগ থেকেই বাঙালির জীবন ও কর্ম রুপালি ইলিশের সঙ্গে সম্পর্কিত। বাংলা সাহিত্যে ইলিশের স্থান অহরহ দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের ইলিশ-গবেষক দিগেন বর্মন তো ইলিশ নিয়ে একটি বই-ই লিখে ফেলেছন। নাম দিয়েছেন ‘ইলিশ পুরাণ’। তিনি লিখেছেন, ‘ইল্লিশো মধুর/স্নিগ্ধো রোচনো/বহ্নিবর্জনঃ/পিত্তিকৃৎ কফকৃৎ/কিঞ্চিল্লঘু ধর্মোহ নিলাজহঃ’ অর্থাৎ ইলিশ মাছ মধুর, স্নিগ্ধ, রোচক ও বলবর্ধক, পিত্তকারী, কিঞ্চিৎ কফকারী, লঘু পুষ্টিকর ও বাতনাশক।

বাঙালির রসনায় মাছের রাজা হিসেবে গণ্য হয়ে আসছে ইলিশ। কিন্তু দামের কারণে সেটি এখন রাজাদের মাছে পরিণত হয়েছে। ইলিশ নিয়ে স্মৃতিচারণ করছিলেন বরিশালের কীর্তনখোলা তীরের ফলপট্টি এলাকার শিল্পী ললিত দাস (৭৯)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, কীর্তনখোলা পাড়েই তাঁর শৈশব ও বেড়ে ওঠা। এখানে ইলিশ নিয়ে সারি সারি বাঁধা নৌকা ভিড়ত। এত মাছ ছিল বিক্রির মতো যে ক্রেতা পাওয়া যেত না। অনেক মাছ পচে যেত। এতে যাতে দুর্গন্ধ না ছড়ায়, সে জন্য সেখানে ডিজেল-পোড়া মবিল ফেলা হতো।

ললিত দাস বলেন, এখন তো ওজন করে, কেজি দরে বিক্রি হয়। নব্বইয়ের দশকেও জোড়া-হালি হিসেবে বিক্রি হতো। সত্তরের দশকে এক-দেড় টাকায় এক হালি ইলিশ কেনা যেত। ২৫ থেকে ৩০ বছর আগেও ভরা বর্ষায় ১০ থেকে ১৫ টাকায় জোড়া ইলিশ কেনা যেত। প্রথম দিকে নৌকা ও পরে ট্রলারবোঝাই করে সাগর-নদী থেকে জেলেরা ইলিশ নিয়ে ঘাটে ফিরতেন। বর্ষা মানেই ইলিশের ম–ম গন্ধ ভাসত চারপাশ। এখন এসব গল্পের মতো মনে হবে। এসবই এখন স্মৃতি।