ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে প্রায়ই দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে ট্রেন। রেলপথটিতে বগি লাইনচ্যুত ও ইঞ্জিন বিকল হয়ে ট্রেন চলাচল বাধাগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটছে বারবার। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন যাত্রীরা। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রেলপথটি দীর্ঘদিনের পুরোনো। সেই সঙ্গে এই পথে চলাচলকারী অধিকাংশ ট্রেনের বগি ও ইঞ্জিন পুরোনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ। এসব কারণে দুর্ঘটনার সংখ্যা বেশি।
গত সপ্তাহের বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার ময়মনসিংহের গফরগাঁও রেলস্টেশনে দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। চলাচলকারী ট্রেনের ইঞ্জিনগুলোর সমস্যার কারণে এ অবস্থা হচ্ছে বলে জানান গফরগাঁও রেলস্টেশনের স্টেশনমাস্টার আবদুল্লাহ আল হারুন। তিনি বলেন, অধিকাংশ ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। ইঞ্জিনগুলো ভালো অবস্থানে নেই। ইঞ্জিনের সংকট চলছে। এ ছাড়া লাইনও অনেক পুরোনো। সবদিক মিলিয়ে ময়মনসিংহ অঞ্চলে রেল খাত ভালো অবস্থানে নেই। রেললাইন, স্টেশন, অবকাঠামো—সবই সমস্যায় জর্জরিত।
১ অক্টোবর থেকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী ‘ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস’ দুবার লাইনচ্যুত এবং নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী দুটি ট্রেনের ইঞ্জিন দুবার বিকল হয়েছে ময়মনসিংহের গফরগাঁও ও ত্রিশাল এলাকায়। এর মধ্যে গত শুক্রবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে গফরগাঁও রেলস্টেশন এলাকায় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনের ইঞ্জিন বিকল হয়। এতে ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। পরে বেলা পৌনে দুইটার দিকে ইঞ্জিনটি মেরামত করা হলে পুনরায় ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়। আগের দিন গত বৃহস্পতিবার বেলা পৌনে একটার দিকে ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী মহুয়া কমিউটার ট্রেন গফরগাঁও রেলস্টেশন থেকে ছেড়ে যাওয়ার সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। পরে বেলা সাড়ে তিনটার দিকে উদ্ধারকারী ট্রেন গিয়ে আটকে পড়া ট্রেনটিকে ময়মনসিংহের উদ্দেশে নিয়ে যায়।
১১ অক্টোবর ময়মনসিংহের ত্রিশালের ফাতেমানগর স্টেশন এলাকায় দেওয়ানগঞ্জগামী ‘ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস’ ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এতে প্রায় এক ঘণ্টা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। এর আগে ১ অক্টোবর ‘ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস’ ট্রেনটি ত্রিশালের ধলা এলাকায় লাইনচ্যুত হয়। ওই দিন উদ্ধার কার্যক্রম শেষে সাড়ে আট ঘণ্টা পর ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথে ট্রেন চলাচল স্বাভাবিক হয়েছিল।
এ বিষয়ে রেলওয়ে প্রকৌশল বিভাগের ময়মনসিংহের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথটি অনেক পুরোনো। পুরোনো ট্র্যাক, টানা বৃষ্টির মতো সমস্যা তো আছেই। অন্যান্য এলাকায় প্রকল্পের আওতায় নতুন রেললাইন ও ইঞ্জিন যুক্ত হচ্ছে। কিন্তু এ রুটে চলাচলকারী লোকোগুলো (ইঞ্জিন) অনেক পুরোনো, কোনোটি আবার মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ১০-১৫ বছর ধরে চলছে। আছে জনবলের ঘাটতিও। লাইন মেরামতের জন্য চাহিদামতো মালামাল না পাওয়াসহ নানা কারণে ট্রেনগুলোকে দুর্ঘটনার মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
একই কথা বলেন ময়মনসিংহ লোকোশেডের ইনচার্জ ফারুক হোসেন খান। তিনি বলেন, এই পথে চলাচলকারী ইঞ্জিনগুলো অন্তত ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে চলছে। এগুলোর কার্যক্ষমতা অনেকাংশে কমে গেছে। ইঞ্জিনের বিভিন্ন যন্ত্রাংশও পাওয়া যায় না। শ্রমিকের সংখ্যা কমে গেছে। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে নিয়োগ বন্ধ আছে। সব মিলিয়ে স্থবিরতা চলছে।
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জগামী ব্রহ্মপুত্র এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হওয়ার দুটি ঘটনায় পাঁচ সদস্য ও চার সদস্যবিশিষ্ট দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। দ্রুত সময়ের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটিতে আছেন রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় পরিবহন কর্মকর্তা মো. খায়রুল কবির। তিনি বলেন, তদন্তে অনেক কিছু দেখার থাকে। যে কোচ পড়ে গেছে সেটি, ইঞ্জিনের গতিবেগ, লাইনের অবস্থা বা সমস্যা, বিভিন্ন পার্টস দেখতে হয়। যাঁরা ঘটনাস্থলে ছিলেন, তাঁদের জবানবন্দি নিতে হয়। বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলমান। তদন্ত শেষে দুর্ঘটনার কারণ বলা যাবে।
ময়মনসিংহ-ঢাকা রেলপথ ডুয়েলগেজে উন্নত করাসহ ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে বিশেষ ট্রেন চালুর দাবিতে আন্দোলন করে আসছেন ময়মনসিংহ নাগরিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই রেলপথ ব্রিটিশ আমলের। এত পুরোনো রেলপথ দিয়ে উন্নত যাত্রীসেবা দেওয়া সম্ভব নয়। চলাচলকারী ট্রেনগুলোর অবস্থাও নাজুক। রেলপথটি ডুয়েলগেজে উন্নীত করে, নতুন ট্রেন দিয়ে যাত্রী দুর্ভোগ কমানোর উদ্যোগ নেবে সরকার, এমনটিই প্রত্যাশা।