চাঁপাইনবাবগঞ্জ–৩ আসনের অনেক কেন্দ্রে ১২টা পর্যন্ত ৫ শতাংশ ভোটও পড়েনি

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে সকালে সাড়ে আটটায় উপনির্বাচনের ভোটগ্রন শুরু হলেও ভোটারদের উপস্থিতি কম। আজ সকাল সাড়ে নয়টায় জেলা আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে
ছবি:  প্রথম আলো

দুপুর ১২টা বেজে যাচ্ছে। ভোটকেন্দ্রে ভোটার আসছেন না। তখন পর্যন্ত ৫ শতাংশ ভোটারও কেন্দ্রে আসেননি। আয়েশা বেগম নামের এক নারী ভোটারকে পেয়ে ভোট গ্রহণের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশ সদস্য তাঁকে বললেন, ‘বাড়ি গিয়ে লোকজন পাঠিয়ে দেন, এসে ভোট দিয়ে যাক।’ জবাবে ওই নারী বললেন, ‘হাঁরঘে (আমাদের) কথা কি শুনবে? আপনারা গিয়ে মাইকিং করেন গা।’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শংকরবাটি হেফজুল উলুম হাফেজা খানম কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি নিয়ে পুলিশ-ভোটারের এই কথোপকথন শোনা গেল। বেলা একটা পর্যন্ত অন্তত ১০টি কেন্দ্রের ভোটার উপস্থিতির খবর নিয়ে জানা গেছে, বিশেষ করে নারী কেন্দ্রগুলোতে ৫ শতাংশের বেশি ভোট পড়েনি।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসন থেকে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদের পদত্যাগের পর আজ সোমবার উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে ভোটের লড়াইয়ে নেমেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আবদুল ওদুদ, জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী সামিউল হক লিটন (আপেল) ও বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ মনোনীত প্রার্থী কামরুজ্জামান খান (টেলিভিশন)।

শংকরবাটি হেফজুল উলুম হাফেজা খানম কামিল মাদ্রাসা কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ২৪২ জন। এটি একটি নারী ভোটকেন্দ্র। বেলা ১১টায় এ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে ৩ দশমিক ৫২ শতাংশ। তার এক ঘণ্টা পর দুপুর ১২টায় ভোট পড়ার হার ৪ দশমিক ৭৭।

এ কেন্দ্রে আরেক ভোটারকে ভোট দিতে দেখা যায়। সায়েরা বেগম নামের এই ভোটার বললেন, তিনি বাড়িতে গিয়ে রান্না চড়াবেন। এ জন্য আগেভাগে ভোট দিতে এসেছেন।
ভোটকেন্দ্রের বাইরে স্লিপ দেওয়ার জন্য দুটি জায়গায় পাটি বিছিয়ে নৌকার সমর্থকদের ভিড় করতে দেখা গেছে। পাশাপাশি আরেকটি জায়গায় বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের বসে থাকতে দেখা গেছে।

বিদ্রোহী প্রার্থীর এক সমর্থক দাবি করেছেন, এ কেন্দ্রে তাঁরা ৯০টি পেলে নৌকার বাক্সে পড়বে ১০টি ভোট। এ কেন্দ্রের বাইরে আরেকটি দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন এক ভোটার। তিনি দাবি করেন, ভোট ভালোই হচ্ছে। ফয়সাল নামের এক যুবক ভোট না দিয়েই চলে যাচ্ছেন। কেন ভোট দিলেন না, জানতে চাইলে একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া ওই যুবক বলেন, ‘কেন ভোট দেব, বুঝতে পারছি না, তাই ভোট না দিয়েই চলে যাচ্ছি।’ তাঁর ভাষায়, শুধু নৌকার একজন প্রার্থী আছেন। তাঁকে তিনি ভোট দিতে চান না। কারণ, একজন মানুষের ভিন্নমত থাকতেই পারে। তাঁর ভোট প্রয়োগ করার কোনো জায়গা নেই। একজন নৌকার বিদ্রোহী প্রার্থী আছেন, বিদ্রোহী প্রার্থীকে তিনি কেন ভোট দেবেন? একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী আছেন টেলিভিশন মার্কা নিয়ে। তাঁকে কোনো দিন দেখেননি, চেনেন না, তাই ভোট দেবেন না বলে তিনি জানালেন।

দক্ষিণ চরাগ্রাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবন দুটি কেন্দ্র। নিচতলায় নারী এবং দ্বিতীয় তলায় পুরুষ ভোটকেন্দ্র। নিচতলায় নারী ভোটকেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, সেখানেও ভোটার উপস্থিতির একই দৃশ্য। কেন্দ্রের মোট ভোট ২ হাজার ৩৮, বেলা ১টা পর্যন্ত ভোট পড়েছে ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। নারী ও পুরুষ ভোটার উপস্থিতি তুলনা করার জন্য দোতলায় পুরুষ কেন্দ্রে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেন্দ্রের মোট ভোট ২ হাজার ৪৮, বেলা ১টা পর্যন্ত ভোট দিয়েছেন ২৮৬ জন, অর্থাৎ প্রায় ১৩ শতাংশ।

ভোরে শুরুতে সকাল সাড়ে আটটায় তাজকেরাতুন স্বরূপনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে চারজন প্রবীণ ভোটারের উপস্থিতি দেখা গিয়েছিল। তার মধ্যে ৮০ বছর বয়সী তোজাম্মেল হক, ৭০ বছর বয়সী হাবিবুর রহমান, ৭২ বছর বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোয়াজ্জেম হোসেন এবং ৬৬ বছর বয়সী নারী ভোটার সেতারা বেগম ভোট দিতে এসেছেন। সেতারা বেগম তখন বলেছিলেন, সকালে হাঁটতে বের হতে হয়। সেই সঙ্গে ভোটটা দেওয়া হবে, তাই মনে করে এসেছেন।

বেলা একটায় ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা জন পলাশ হাসদার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ভোটার উপস্থিতি কম। কখনো ভোটার আসছেন, কখনো এমনি বসে থাকতে হচ্ছে। কেন্দ্রের ২ হাজার ৪০ জন ভোটার। দুপুর ১২টা পর্যন্ত ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ ভোট পড়েছে।

২০১৬ সালের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা সদর উপজেলার সঙ্গে মহানন্দা নদীর দক্ষিণ পাশের মানুষের সড়ক সংযোগ স্থাপন করার জন্য শেখ হাসিনা সেতু নির্মাণ করে সরকার। সেতুর দক্ষিণ পাশের বাসিন্দা আবদুল গাফফারের ভাষায়, এ সেতু ইসলামপুর ইউনিয়নের মানুষের জীবন বদলে দিয়েছে। সে হিসেবে ভোটটা নৌকায় দেওয়া দরকার। কিন্তু ভোট দিতে কেউ আসছেন না।

ইউনিয়নের মানুষ এই উপনির্বাচনে কেমন ভোট দিচ্ছেন, তা দেখার জন্য ইউনিয়নের তেরোরসিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, কেন্দ্রের নারী ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি খুব কম। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৩২৬ জন। বেলা একটা পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ভোট পড়েছে মাত্র ৫ দশমিক ৪৮ শতাংশ। কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার আবদুস সামাদ বলেন, তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে ভোট গ্রহণের দায়িত্ব পালন করছেন। এ রকম কম ভোটার উপস্থিতি কোনো নির্বাচনে তিনি দেখেননি। তিনি বলেন, দুপুর ১২টা পর্যন্ত তার একটি বুথে একজন ভোটারও ভোট দিতে আসেননি। দুপুর ১২টার পর দুজন নারী ভোটার ভোট দিয়েছেন। এ বিদ্যালয় এর অপর পাশেই পুরুষ ভোটকেন্দ্র করা হয়েছে। এ কেন্দ্রে মোট ভোটার ২ হাজার ৫১৫ জন। এখানে বেলা একটা পর্যন্ত ভোট পড়েছে মাত্র ১০ দশমিক ৯৭ শতাংশ।

তবে কেন্দ্রের বাইরে একটু উৎসবমুখর পরিবেশ লক্ষ করা যায়। এটি মূলত চর এলাকা। মিষ্টি ও জিলাপির দোকান নিয়ে বসেছিলেন জিয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভোটার নেই। বেচাবিক্রি তেমন হচ্ছে না। পাশ থেকে দাঁড়িয়ে আরিফ হোসেন বলেন, ‘রান্না পাকা করে, খাওয়াদাওয়া সেরে মেয়েরা বিকেলের আগে আগে ভোট দিতে আসবে।’

জেলা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, এ আসনে ১৭২ জন প্রিসাইডিং, ১ হাজার ২৪০ জন সহকারী প্রিসাইডিং ও ২ হাজার ৪৮০ জন পোলিং কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। মোট ভোটার ৪ লাখ ১১ হাজার ৪৯৫ জন। এর মধ্যে পুরুষ ২ লাখ ৫ হাজার ৮৮৩ জন এবং নারী ভোটার ২ লাখ ৫ হাজার ৬১২ জন। এ আসনে ১৭২টি কেন্দ্র ও ভোটকক্ষ ১ হাজার ২৪০টি।