দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন নৌপথে চলাচলকারী লঞ্চগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। একই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নৌপথগুলোও। পদ্মা সেতু চালুর পর নৌপথে যাত্রী কমে যাওয়া এবং দুই দফায় জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে লোকসানের মুখে লঞ্চ চলাচল বন্ধ করে দিচ্ছেন মালিকেরা। এতে একসময় যাত্রীদের কোলাহলে মুখর নদীবন্দরগুলোয় এখন বিরাজ করছে সুনসান নীরবতা।
শিপিং অ্যান্ড কমিউনিকেশন রিপোর্টার্স ফোরাম (এসসিআরএফ) গত বৃহস্পতিবার এক প্রতিবেদনে বলেছে, পদ্মা সেতু চালুর আগে প্রতিদিন ঢাকা থেকে অন্তত ৫০ হাজার মানুষ লঞ্চে বরিশালসহ উপকূলীয় বিভিন্ন জেলায় যেত। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ ছিল বরিশাল, পটুয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, পিরোজপুর ও ঝালকাঠিগামী লঞ্চের যাত্রী। এক বছরের ব্যবধানে এ সংখ্যা ১৭ হাজার কমে ৩৩ হাজার হয়েছে। এই হিসাবে ঢাকার লঞ্চযাত্রী কমেছে ৩৪ শতাংশ। গত বছরের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্র বলছে, ঢাকা থেকে বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের ১৪টি রুটের মধ্যে ৩টি চূড়ান্তভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। এগুলো হলো বরগুনা, আমতলী, ভান্ডারিয়া। এ ছাড়া ঝালকাঠি রুটটিতে অনিয়মিত একটি লঞ্চ চলাচল করছে। বরিশাল ও পটুয়াখালী রুটে লঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে যথাক্রমে দুটি ও একটি করা হয়েছে। কেবল ভোলা জেলার আটটি রুটে এখনো নিয়মিত আগের মতোই লঞ্চ চলাচল করলেও যাত্রীর সংখ্যা কমেছে। এ অঞ্চলের ১৮টি ঘাটের ৮টি এখনো ইজারা দেওয়ার লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বেশি যাত্রী পরিবহন করা রুট হচ্ছে বরিশাল-ঢাকা। এই রুটে দেশের সর্ববৃহৎ ও বিলাসবহুল লঞ্চগুলো যাত্রী পরিবহন করত। আগে প্রতিদিন যেখানে সাত থেকে আটটি লঞ্চ যাত্রী পরিবহনে নিয়োজিত ছিল, সেখানে এখন মাত্র দুটি লঞ্চ চলাচল করছে। তা–ও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না।
সর্বশেষ ২২ আগস্ট বরগুনা-ঢাকা নৌপথে লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। এখান থেকে আগে প্রতিদিন তিনটি লঞ্চ চলাচল করলেও বছরখানেক আগে তা কমিয়ে একটি করা হয়েছিল। সেটিও এবার বন্ধ হয়ে গেল। এই রুটে চলাচলকারী এম কে শিপিং লাইনস কোম্পানির মালিক মাসুম খান বলেন, ‘আমরা আপাতত ঢাকা-বরগুনা রুটের লঞ্চ চলাচল বন্ধ রেখেছি। প্রতিটি ট্রিপে আমাদের দেড় থেকে দুই লাখ টাকা লোকসান হয়। জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ায় অনেক লোকসান হচ্ছে।’
এর আগে বন্ধ হয়ে যায় বরগুনার আমতলী-ঢাকা পথের লঞ্চ চলাচল। আমতলী-ঢাকা রুটে চলাচলকারী এমভি ইয়াদ লঞ্চের মালিক মামুন অর রশিদ বলেন, যাত্রীসংকটে লোকসানের মুখে গত ৩০ জুলাই থেকে লঞ্চ বন্ধ করে রেখেছেন। ওই রুটে দৈনিক এক লাখ টাকা লোকসান গুনতে হয়। এত লোকসান আর গুনতে পারছেন না।
একইভাবে পিরোজপুরের ভান্ডারিয়া-ঢাকা নৌপথও বন্ধ হয়ে গেছে। ভোলা ছাড়া অন্য যেসব রুটে লঞ্চের সংখ্যা কমিয়ে যাত্রী পরিবহন অব্যাহত আছে, সেগুলোও যাত্রীসংকটে যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে।
লঞ্চমালিকদের সংগঠন অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল যাত্রী পরিবহন (যাপ) সংস্থার কেন্দ্রীয় সহসভাপতি ও সুন্দরবন লঞ্চের মালিক সাইদুর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকা-বরিশাল নৌপথে যাত্রীসংকট শুরু হলেও ভাড়া কমিয়ে কিছুটা লোকসান কমানো সম্ভব ছিল। কিন্তু জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর লঞ্চমালিকদের চূড়ান্ত ক্ষতি হয়েছে। ভাড়া বাড়ানোর কারণে কেবিনের যাত্রী ২০ থেকে ৩০ শতাংশের বেশি পাওয়া যায় না। প্রতি ট্রিপে লোকসান দিতে হয় দু–তিন লাখ টাকা। এর প্রভাব পড়েছে এ অঞ্চলের সর্বত্র।
লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। কারণ, সড়কপথে এখন ঢাকা যেতে ন্যূনতম ৬০০ টাকা ব্যয় হয়। কিন্তু লঞ্চে ৩০০ টাকায় যাতায়াত করা যায়। গত বছর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর ডেকের ভাড়া ৪০০ থেকে ৫০০ করা হয়েছিল। এ কারণে যাত্রীরা লঞ্চ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এখন পুনরায় ভাড়া কমিয়েও যাত্রীদের আর ফেরানো যাচ্ছে না।
লঞ্চ চলাচল অব্যাহত রাখতে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়া উচিত, না হলে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে মনে করেন বরিশাল লঞ্চযাত্রী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক দেওয়ান আবদুর রশিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, লঞ্চ চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে সড়কপথের পরিবহনমালিকদের হাতে একচেটিয়া ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে। তখন তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া নির্ধারণ করবে। এতে বিকল্প না থাকায় সব যাত্রীকেই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে যাতায়াত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে লঞ্চমালিকদের যাত্রীসেবা বাড়ানোর পাশাপাশি যাত্রীদেরও আবার লঞ্চমুখী হওয়া উচিত বলে মত দেন তিনি।
দক্ষিণাঞ্চলের ব্যবসায়ীরা বলছেন, নৌপথে পণ্য পরিবহন সাশ্রয়ী। কিন্তু সড়কপথে এখন দ্বিগুণ-তিন গুণ ব্যয় বেড়েছে। এ অঞ্চলের যাত্রীবাহী লঞ্চগুলোয় বিপুল পরিমাণ পণ্য পরিবহন হয়। এসব লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেলে বাড়তি ব্যয়ের বোঝা ভোক্তাদের মাথায় চাপবে। এ কারণে বাজারেও এর প্রভাব পড়বে।
বরগুনা-ঢাকা রুটে লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাজরে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন ওই অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা। বরগুনার বেতাগী শহরের কাপড় ব্যবসায়ী হারুন অর রশিদ বলেন, লঞ্চ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প পথে মাল পরিবহনে ব্যয় বেড়ে গেছে। এ কারণে বেশি দামে পণ্য বেচতে বাধ্য হচ্ছেন।
বরগুনা জেলা বণিক সমিতির সহসভাপতি জহিরুল হক বলেন, প্রাচীন এই নৌপথ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বরগুনার ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়েছে। পণ্য পরিবহনের ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। এরই মধ্যে এর প্রভাব বাজারে পড়তে শুরু করেছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, ‘আমাদের নৌ নেটওয়ার্ক এবং সমন্বিত নেটওয়ার্ক নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অথচ পণ্য পরিবহনের জন্য নৌপথ হচ্ছে সবচেয়ে সাশ্রয়ী। কিন্তু নৌপথের সঙ্গে সড়কের যে পরিমাণ সংযোগ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, তা আমরা বাড়াইনি। এ জন্য সব সময়ই আমাদের নদী, নৌপথ উপেক্ষিত হয়েছে। এখন তা আরও বেশি হুমকির মুখে পড়বে।’
বিআইডব্লিটিএর বরিশাল অঞ্চলের নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের উপপরিচালক আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, এ অঞ্চলের নৌ চলাচল এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। অনেক রুটে লঞ্চ বন্ধ হয়ে গেছে। বরিশালে দুটি লঞ্চ চলছে, তাতে যাত্রী কম। এগুলো কত দিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় আছে। বিশাল এই নৌপথ বন্ধ হলে নৌবন্দরের অবকাঠামো হুমকিতে পড়বে, নদীপথগুলোও অরক্ষিত হয়ে পড়বে। তবে বিআইডব্লিউটিএ আন্তরিকভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে নৌপথগুলোয় নৌ চলাচল অব্যাহত রাখতে।