উপজেলা পর্যায়ে ছাত্রলীগের সভাপতি থেকে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হয়েছিলেন। পরে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। সবখানেই ছিল তাঁর বেপরোয়া আচরণ। দলীয় প্রভাবে এলাকায় দখল ও চাঁদাবাজিতে ছিলেন সবার থেকে এগিয়ে।
কেউ কথা না শুনলে তিনি নিজ কার্যালয়ে ডেকে এনে করতেন নির্যাতন। নিজস্ব বাহিনী দিয়ে হামলা করতেন বাড়িতে। তাঁর হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধা, শিক্ষক, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ীসহ অনেকে। তিনি হলেন খুলনার কয়রা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান বাহারুল ইসলাম। গত ১৫ বছরে বিপুল সম্পদ ও অর্থের মালিক হয়েছেন তিনি। গত ৫ আগস্ট ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর পরিবারসহ এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান বাহারুল। এরপর থেকে তিনি আর এলাকায় ফেরেননি।
দলীয় সূত্র ও ভুক্তভোগী মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০০৯ সাল পর্যন্ত ছাত্রলীগের সাধারণ কর্মী ছিলেন বাহারুল। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর কয়রা সদরে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তোলেন তিনি। তখন বাহারুলের নেতৃত্বে ২-৩ মাসের মধ্যে ৬০টি চিংড়িঘের দখল করা হয়। সংবাদপত্রে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে বাহারুলের নেতৃত্বে কয়রায় প্রেস ক্লাবে হামলা করা হয়। এতে দুই সাংবাদিক গুরুতর আহত হন।
এর কয়েক মাস পরেই বাহারুলকে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি করা হয়। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি। চলতে থাকে দখল ও চাঁদাবাজি। ২০১০ সালে উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশি ইউপির চেয়ারম্যান মনজুর আলমকে (নান্নু) মারধর করে বাহারুলের বাহিনী। একই বছর চাঁদার টাকা না দেওয়ায় কোহিনুর ইসলাম নামের এক চিংড়ি ঘের ব্যবসায়ীর ওপর হামলা করা হয়।
২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদকের পদ পান বাহারুল। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এলাকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা চালায় বাহারুলের বাহিনী। তখন এলাকায় ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি হয়। ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে শুরু করেন বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মীরা। তখন বাহারুলের বিরুদ্ধে কথা বলায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার ও সাংবাদিক মতিয়ার রহমানকে রাস্তায় ফেলে বেধড়ক মারধর করেন বাহারুল। একই সময়ে আরেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক মওলা বকসকেও মারধর করা হয়। তবে দল থেকে বাহারুলের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি; বরং ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগাঠনিক সম্পাদকের পদ পান বাহারুল। এরপর আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তিনি।
২০১৯ সালে কয়রা সদর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডে হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিপি তালিকাভুক্ত ৪০ বিঘা জমি দখল করেন এবং এর শ্রেণি পরিবর্তন করে প্লট আকারে বিক্রি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কয়রা সদরে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রায় ১০ কাঠা জমি দখলে নিয়ে দোকান ভাড়া দেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কয়রা কপোতাক্ষ কলেজের সামনে সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন ১৬ শতক জমির ওপর ৫ তলা ভবন নির্মাণ করে হাসপাতাল বানিয়েছেন তিনি।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৯ সালে ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার আগে বাহারুলের পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল; বাস করতেন টিনের ঘরে। তাঁর বাবা ফজর আলী সানা জমি পরিমাপকারী (আমিন) হওয়ায় বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ জমির খবর রাখতেন। এভাবে বাবার সহযোগিতায় বাহারুল অবৈধভাবে জমি দখল করে কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।
২০২২ সালে কয়রায় স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে লোনাপানির ঘের বন্ধের নির্দেশনা আসে। এ সময় বাহারুল তাঁর বাহিনী দিয়ে প্রথমে লোনাপানি উত্তোলনের পাইপ ভেঙে দেওয়া শুরু করেন। পরে ঘেরপ্রতি পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা নিয়ে লোনাপানি তুলে ঘের করার ব্যবস্থাও করে দেন তিনি। স্বাস্থ্যসেবার নামে দুটি অবৈধ লাইসেন্সবিহীন বহুতল হাসপাতালের মালিক ও পরিচালক তিনি। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের পাশে এক মাদ্রাসা শিক্ষকের জমি দখল করে সেখানে শেখ রাসেল প্রতিবন্ধী স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষক নিয়োগের নামে সেখান থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন টাকা।
২০১৩ সালে উত্তর বেদকাশি কাছারি বাড়ি বটতলা বৃক্ষমেলায় আধিপাত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও বাহারুলের বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। তৎকালীন মেলা কমিটির সভাপতি সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গুলির ঘটনায় মামলা হয়। বাহারুল ওই মামলার প্রধান আসামি ছিলেন। এটা নিজেদের দলীয় বিষয়, তাই আমরা মামলা তুলে নিয়েছিলাম।’
তাঁর (বাহারুল) দখলদারির বিষয়ে অভিযোগ করতে অনেকেই ইউনিয়ন পরিষদেও আসছেন। আমরা ভুক্তভোগীদের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছি।লুৎফর রহমান, ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান, কয়রা ইউনিয়ন
২০২১ সালে কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচনে বাহারুলের বিরুদ্ধে ভোটের দিন কেন্দ্রে মারধর ও দখলের অভিযোগে সদর ইউনিয়নের নির্বাচন স্থগিত করা হয়। পরে সেখানে নির্বাচন হলে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তিনি।
২০২২ সালে উপজেলার উত্তর চক মাদ্রাসার ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাসুদুল আলমকে তুলে এনে বাহারুলের অফিসকক্ষে বেঁধে মারধর করা হয়। এতে ওই অধ্যক্ষের একটি চোখ নষ্ট হওয়ার উপক্রম হয়।
মাসুদুল আলম বলেন, ‘বাহারুলকে মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ সভাপতি না করায় সে আমার কাছ থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা নেয়। প্রাণের ভয়ে টাকা দিলেও সে আমাকে তুলে নিয়ে মারধর করে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে বাহারুল ইসলামের ভাষ্য পাওয়া যায়নি। ৫ আগস্টের পর তিনি পরিবারসহ অজ্ঞাত স্থানে রয়েছেন। তাঁর মুঠোফোন নম্বরও বন্ধ আছে। তাঁর অনুপস্থিতিতে কয়রা সদর ইউনিয়ন পরিষদে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যনের দায়িত্ব পালন করছেন ইউপি সদস্য লুৎফর রহমান। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার সময় তাঁর (বাহারুল) বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করেননি। এখন অনেক অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে। তাঁর দখলদারির বিষয়ে অভিযোগ করতে অনেকেই ইউনিয়ন পরিষদেও আসছেন। আমরা ভুক্তভোগীদের স্থানীয় প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করার পরামর্শ দিচ্ছি।’