লবণাক্ততার কারণে ফসল বলতে ছিল শুধু আমন ধান। সেই জমিতে এখন সারা বছর ফসলের চাষ হচ্ছে। ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামেই চোখে পড়ে সবজির খেত। সারা বছরই চাষাবাদে ব্যস্ত থাকেন চাষিরা।
বঙ্গোপসাগর উপকূলে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের অবস্থান। ইউনিয়নের চারদিকেই ছোট-বড় অসংখ্য নদ–নদী। বছরের অধিকাংশ সময় ফসলি জমি থাকত পানির নিচে। লবণাক্ততার কারণে ফসল বলতে ছিল শুধু আমন ধান। সেই জমিতে এখন সারা বছর ফসলের চাষ হচ্ছে। ইউনিয়নের ১৫টি গ্রামেই চোখে পড়ে সবজির খেত। সারা বছরই চাষাবাদে ব্যস্ত থাকেন চাষিরা। জেলার চাহিদা মিটিয়ে এসব সবজি যাচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
নীলগঞ্জ সবজি চাষে সাফল্য ও আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে জাকির হোসেনের (৪০) হাত ধরে। তাঁর বাড়ি নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামে। ছোটবেলায় কৃষিকাজে আগ্রহ ছিল না তাঁর। ঢাকায় নির্মাণশ্রমিকের কাজ করতেন তিনি। সেখানে সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে বাড়িতে চলে আসেন জাকির। একপর্যায়ে বাড়ির পাশে সবজি চাষ শুরু করেন তিনি। তবে গ্রামে মিষ্টি পানির অভাব ছিল। যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না থাকায় সবজি বিক্রি করতেও ঝামেলা পোহাতে হতো। এসব সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার উপায় খুঁজতে থাকেন জাকির। ইউটিউবে গ্রিনহাউস মডেলের বিষমুক্ত সবজির পাশাপাশি ভিনদেশি সবজি আবাদের উদ্যোগ নেন। এতে সফলতা পান জাকির।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগের কথা। লোনাপানির কারণে আমন আবাদেই কৃষকের হিমশিম খেতে হতো। সবজি চাষের কথা তো চিন্তাই করা যেত না। মিঠাপানির ব্যবস্থা ছিল না। গ্রামের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পাখিমারা ক্লোজার খালের পানিও ছিল লবণাক্ত। এই অবস্থায় মিঠাপানি সংরক্ষণের জন্য সরকারি উদ্যোগে খালে বাঁধ দেওয়া হয়। খালে পানি ওঠানামার জন্য বাঁধের বিভিন্ন অংশে ৯টি জলকপাট নির্মাণ করা হয়। স্বাধীনতার পর নীলগঞ্জ ইউনিয়নের এলেমপুর গ্রামের কয়েকজন কৃষক প্রথমে সবজি চাষের উদ্যোগ নেন। তবে তাঁদের সেই উদ্যোগ তেমন সফল হয়নি।
জাকির হোসেন ২০১৩ সালে পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এক একর জমি নিয়ে সবজি চাষ শুরু করেন। প্রথমে সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ শুরু করেন। এতে মিঠাপানির সংকট দেখা দেয়। এই অবস্থায় তিনি এলাকার কৃষকদের একত্র করে পাখিমারা খালে অকেজো জলকপাটসহ বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে মিঠাপানি সংরক্ষণ করেন। এরপর সবজি চাষে সফলতা আসতে থাকে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে গ্রিনহাউস মডেলের আদলে বাঁশ-স্টিলের কাঠামো তৈরি করে পলিথিনের ঢাকনি দিয়ে সবজি চাষ শুরু করেন। আবাদ করেন বোম্বাই মরিচ, তিন ধরনের ফুলকপি, টমেটো, গাজর, লেটুসপাতাসহ আরও কিছু সবজি।
জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রথমে আশপাশের কৃষকেরা এই পদ্ধতি দেখে তামাশা করতেন। কিন্তু সাফল্য পাওয়ায় অন্যরা এতে উৎসাহী হন। এখন এলাকার তিন শতাধিক কৃষক এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করছেন। এসব সবজি ও ফসলের দাম বেশি। কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন। আমি আরও এক একর জমি বর্গা নিয়ে চাষ করছি। চাষাবাদের জন্য এলাকার কৃষকেরা আমার কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছেন।’
পড়ালেখার পাশাপাশি চাষাবাদ
জাকির হোসেনের সফলতা দেখে নীলগঞ্জ ইউনিয়নের শিক্ষিত বেকার তরুণ-যুবকেরা কৃষিকাজে এগিয়ে এসেছেন। কুমিরমারা গ্রামের হেমায়েত উদ্দিন (২৮) স্নাতক পাস করেছেন পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে। লেখাপড়া করে চাকরি করার ইচ্ছা ছিল হেমায়েতের।
তবে জাকিরের গ্রিনহাউস পদ্ধতির চাষাবাদে সাফল্য দেখে উৎসাহী হন তিনি। হেমায়েত বলেন, গত বছর ১০ শতাংশ জমিতে সবুজ বেষ্টনী পদ্ধতিতে বোম্বাই মরিচ চাষ করেন। খরচ হয়েছিল ৫০ হাজার টাকা। মরিচ বিক্রি করেছিলেন আড়াই লাখ টাকার। এ বছরও তিনি ১০ শতাংশ জমিতে বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছেন। খরচ হয়েছে ২৫ হাজার টাকা। ইতিমধ্যে খেত থেকে এক লাখ টাকার মরিচ বিক্রি করেছেন।
একই গ্রামের মাসুদুর রহমান স্নাতক (সম্মান) দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। তিনিও জাকির হোসেনের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বোম্বাই মরিচের আবাদ করেছেন। ভবিষ্যতে আরও জমি বর্গা নিয়ে টমেটো, বেগুন, ফুলকপি, বাঁধাকপির চাষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাঁর।
জাকির হোসেন বলেন, এলাকায় মিঠাপানির একমাত্র উৎস পাখিমারা ক্লোজার খাল। এর সঙ্গে অভ্যন্তরীণ সাতটি শাখা খাল যুক্ত রয়েছে। মিঠাপানি সংরক্ষণের জন্য খালটিতে ৯টি জলকপাট থাকলেও তা অকেজো। লোনাপানি প্রবেশ করায় চাষাবাদ ব্যাহত হয়। এ অবস্থায় ওই খালে প্রতিবছর নভেম্বরে অস্থায়ীভাবে বাঁধ দিতে হয়। আবার পানির জন্য জুনে সেই বাঁধ কেটে দিতে হয়। অকেজো জলকপাটগুলো সচল থাকলে কৃষকদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হবে না।
এই এলাকায় পরিবহন সমস্যাও প্রকট। জাকির হোসেন বলেন, ইউনিয়নের অভ্যন্তরীণ রাস্তাগুলো কাঁচা। বর্ষা মৌসুমে কৃষকদের ফসল বাজারে নিতে সমস্যায় পড়তে হয়। খালে বাঁধ থাকায় অনেক এলাকার ফসল নৌপথেও আনা সম্ভব হয় না। বাজারে যাওয়ার সড়কগুলো পাকা হলে কৃষকেরা লাভবান হবেন।
নীলগঞ্জ ইউনিয়নে মোট জমি রয়েছে ৬ হাজার ৩০০ হেক্টর। যার ৭০০ হেক্টর জমিতে সারা বছরই সবজি চাষের আওতায় এসেছে। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এ আর এম সাইফুল্লাহ বলেন, নীলগঞ্জে কৃষিকাজে সাফল্যের পেছনে জাকির হোসেনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। প্রতিবছর এখানে প্রায় ১৪ হাজার মেট্রিক টন সবজি উৎপাদিত হয়, যার বাজারমূল্য অন্তত ৩৫ কোটি টাকা। এখানকার বিষমুক্ত সবজি দেশের বিভিন্ন জেলায় যাচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর, পটুয়াখালীর উপপরিচালক নজরুল ইসলাম বলেন, নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষিতে নীরব বিপ্লব ঘটেছে। সেখানে সারা বছর সবজি চাষ হচ্ছে। এই চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জেলার সব উপজেলায় পাইলট আকারে কার্যক্রম গ্রহণের উদ্যোগ নিচ্ছে। এতে অনেক পতিত জমিও আবাদের আওতায় আসবে।