বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগ সদ্য ঘোষিত জেলা ছাত্রলীগের কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছে। মঙ্গলবার রাতের এ ঘোষণায় বরগুনায় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নতুন করে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতারা এই সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা বলেছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির প্রকাশ্য সমাবেশে এমন ঘোষণা দেওয়ায় পুরো জেলায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে বিভাজন ও সংঘাতকে উসকে দেবে। এর উদাহরণ হিসেবে মঙ্গলবার রাতে আমতলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতিকে ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী কুপিয়ে গুরুতর জখম করার ঘটনাও তুলে ধরেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের এই সিদ্ধান্তকে এখতিয়ারবহির্ভূত বলেও উল্লেখ করেছেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় ছাত্রলীগের নেতারা। জেলা আওয়ামী লীগের অবাঞ্ছিত ঘোষণার পর ছাত্রলীগ বুধবার বেলা দুইটার দিকে ১৭ আগস্ট সারা দেশে বোমা হামলার প্রতিবাদে শহরে কালো পতাকা মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে।
জেলা আওয়ামী লীগের ১১ জন নেতা বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, এমনিতেই নতুন কমিটি নিয়ে মাসখানেক ধরে পদবঞ্চিতদের মধ্যে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ ওই দুই নেতার মনঃপূত প্রার্থীরা কমিটিতে স্থান পাননি বলে এসব হচ্ছে। এ নিয়ে ১৫ আগস্টের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেশজুড়ে আলোচিত হয়েছে। তাঁরা মনে করছেন, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের এমন ঘোষণা দেওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই গতকাল রাতে আমতলী উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোয়াজ্জেম খানকে ছাত্রলীগের স্থানীয় কয়েকজন নেতা-কর্মী প্রকাশ্যে কুপিয়ে গুরুতর জখম করেছেন। জেলা নেতাদের এমন অবিবেচনাপ্রসূত ঘোষণা পুরো জেলায় দলীয় সংঘাত-বিভাজনকে অনেকাংশে ত্বরান্বিত করবে।
জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মোতালেব মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের কমিটিকে অবাঞ্ছিত করার ঘোষণা দেওয়ার এখতিয়ার জেলা আওয়ামী লীগের নেই। এটা সভাপতি ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু ও সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবিরের ব্যক্তিগত বিষয়। তাঁরা জেলা আওয়ামী লীগের সভায় এই ঘোষণা দেওয়ার আগে আমাদের মতামত নেননি, আলোচনাও করেননি।’ তিনি বলেন, ছাত্রলীগের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন একমাত্র দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগকে অবাঞ্ছিত করার ঘোষণা অবশ্যই সংঘাতকে উসকে দেবে। পুরো জেলায় দলীয় রাজনীতিতে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি করবে।
কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্পাদকমণ্ডলীর একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে আজ বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ছাত্রলীগ মূল দল আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন। তাই জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা কোনোভাবেই ছাত্রলীগকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করতে পারেন না। জেলা বা উপজেলা কমিটি নিয়ে কোনো ধরনের সমস্যা হলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির কাছে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ বা সুপারিশ করতে পারেন। কিন্তু এভাবে একটি ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা মোটেই সমীচীন হয়নি।
গত সোমবার বরগুনায় জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে জেলা ছাত্রলীগের শোক মিছিলে আরেকটি পক্ষ ইটপাটকেল নিক্ষেপ করার পর পুলিশ লাঠিপেটা করে। এ ঘটনার পর প্রত্যাহার হওয়া অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মহররম আলী ও অন্য পুলিশ সদস্যদের বিচার চেয়ে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগ গতকাল রাতে বিক্ষোভ সমাবেশ করে। বিক্ষোভ মিছিল থেকে জেলা ছাত্রলীগের নবগঠিত কমিটি অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। বিক্ষোভ শেষে স্থানীয় সদর রোডে প্রেসক্লাবের সামনে এক সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সংসদ সদস্য ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু এবং সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির বক্তৃতা দেন।
ওই সমাবেশে ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু বলেন, ‘বরগুনায় এযাবৎ যতগুলো কমিটি হয়েছে, এত নোংরা নিম্নমানের কমিটি আর কখনো হয়নি। জেলা ছাত্রলীগের কমিটির নেতারা ছাত্র কি না, আমাদের সন্দেহ আছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘কাউন্সিল ছাড়া আমরা কোনো কমিটি মানি না। আমরা কেউ এই কমিটি মানব না। জেলা আওয়ামী লীগের কারা এই কমিটির পেছনে কাজ করেছেন, ফুয়েল দিয়েছেন, কারা টাকাপয়সা দিয়েছেন, কারা বরগুনায় গন্ডগোল করেছেন, তার সবই আমরা জানি। তাঁরা এখানেও (সমাবেশে) উপস্থিত আছেন। সম্মেলন ছাড়া আমরা এই জেলা ছাত্রলীগের কমিটি মানি না।’
সমাবেশে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতাদের উদ্দেশে বলেন, ‘সম্মেলন করে, খাবার খেয়ে তাঁরা পালিয়ে গেছেন। তাঁরা কোনো কাউন্সিল করেননি। ঢাকায় গিয়ে টাকা খেয়ে তাঁরা তাঁদের মতো করে কমিটি দিয়েছেন।’ ছাত্রত্বহীন, রাজাকারের সন্তানদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে অভিযোগ এনে জাহাঙ্গীর কবির সমাবেশে বলেন, ‘অচিরেই এই তথাকথিত কমিটি বাতিল করতে হবে। আমরা এই অবৈধ কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করলাম। কোনো লোক তাঁদের সহযোগিতা করবেন না।’
জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের এমন বক্তব্যের বিষয়ে বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক তৌশিকুর রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, ‘বরগুনায় ছাত্রলীগকে নিয়ে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। আমি একজন আইনের ছাত্র। আমাদের ছাত্রত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। অথচ যাঁরা পদ পাননি বলে বিদ্রোহ করেন, তাঁরা কী করেন, এই শহরের সবাই তা জানে। কারা কিশোর গ্যাং সৃষ্টি করে, এটা সবাই অবগত।’
আট বছর পর গত ১৭ জুলাই বরগুনা শহরের সিরাজ উদ্দীন টাউন হল মিলনায়তনে বরগুনা জেলা ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ২৪ জুলাই রাতে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক জেলা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির অনুমোদন দেন। রেজাউল কবিরকে সভাপতি ও তৌশিকুর রহমানকে সাধারণ সম্পাদকসহ ৩৩ জনের নাম ঘোষণা করা হয়। এরপর থেকেই সদ্য ঘোষিত এ কমিটি প্রত্যাখ্যান করে বরগুনা শহরে পদবঞ্চিতরা প্রতিবাদ নামেন। তাঁরা মূলত বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের দুই শীর্ষ নেতার অনুসারী।