পদ্মা নদীর ভাঙনের কারণে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছেন লোকজন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ী রেলবাজার ঘাট এলাকায়
পদ্মা নদীর ভাঙনের কারণে বাড়িঘর ভেঙে নিয়ে যাচ্ছেন লোকজন। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ী রেলবাজার ঘাট এলাকায়

পদ্মার ভাঙনে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন চরের বাসিন্দারা

রাজশাহীতে পদ্মা নদীর ডান তীরে সপ্তাহখানেক ধরে ভারতীয় সীমান্তবর্তী গোদাগাড়ী, বাঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চর এলাকার কয়েকটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে। বাঘার চরে প্রায় ২৫০টি পরিবার নদীভাঙনে গৃহহীন হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরের বাসিন্দাদের অনেকেই এখন ভাঙন আতঙ্কে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন। কেউ কেউ সবকিছুই নৌকায় তুলে নিয়ে চলে আসছেন এপারে। খুঁজছেন বসবাসের নতুন ঠিকানা। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রেলবাজার ঘাটে কয়েকটি নৌকা এসে ভেড়ে। নৌকাগুলোর কোনোটিতে গরু-ছাগল, কোনোটিতে বস্তায় বস্তায় ধান, আবার কোনোটিতে চর থেকে ভেঙে নিয়ে আসা বাড়ির চাল, টিনের ছাউনি ও আসবাবপত্র।

নৌকায় এসেছে গোদাগাড়ী উপজেলার আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চর বয়ারমারি গ্রামের আসগর আলীর পরিবার। আলাপকালে আসগর আলী বলেন, প্রতিবছরই পদ্মায় তাঁদের জায়গাজমি ভাঙে। এরই মধ্যে তাঁর ১৫ বিঘা কৃষিজমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বাড়িও সরিয়েছেন ছয়বার। এবার উপজেলার মাছমারা গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেবেন তাঁরা।

চর আমতলা খাসমহলের বাসিন্দা মো. আলাউদ্দিন জানান, কয়েক দিন ধরে নদীর পানি বাড়ায় তাঁদের এলাকায় কয়েকটা রাস্তাঘাট পানিতে তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে টমেটো ও ধানের খেত। চর বয়ারমারি গ্রামের অন্তত ৫০টি বাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে। চর বয়ারমারির পাশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার জেলেপাড়া গ্রামেও তীব্র নদীভাঙন চলছে। পোলাডাঙ্গা এলাকায় একটি সেতু ছিল। নদীভাঙনে ভেঙে গেছে সেটি।

বন্যাদুর্গত এলাকায় কোনো সহযোগিতা না পেয়ে গোদাগাড়ীর চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা মহিউদ্দিন মিঠু গত বুধবার সকালে ফেসবুক পোস্টে লেখেন, ‘আবারও বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চরের মানুষ ও ফসলি জমি। নেই কোনো সাংবাদিক, নেই কোনো টিভি চ্যানেল, নেই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের কোনো খবর’।

বন্যায় প্লাবিত হয়েছে পেঁপেবাগান। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নে

বাঘা উপজেলার নীচ পলাশী ফতেপুর গ্রামের বোরহান মোল্লা বলেন, তাঁর থাকার ঘরে এখন হাঁটুপানি। রান্না করতে হচ্ছে পাশের বাড়ি থেকে। পলাশী ফতেপুর গ্রামের কৃষক শরিফুল ইসলাম বলেন, বন্যায় তাঁর পেঁপেবাগান পানিতে প্লাবিত হয়ে যাওয়ায় প্রায় ৫০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

লক্ষ্মীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে বন্যার পানি ওঠায় পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ আছে। স্থানীয় চকরাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবদুস সাত্তার বলেন, বন্যার কারণে বিদ্যালয় এলাকায় পানি হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে। আপাতত বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সহযোগিতায় সাধারণ জনগণ কিছু বস্তা ফেলে চকরাজাপুর উচ্চবিদ্যালয়টিকে নদীভাঙন থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন।

চকরাজাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বাবুল দেওয়ান বলেন, তাঁর ইউনিয়নের আতারপাড়া, চৌমাদিয়া, দিয়ারকাদিরপুর, চকরাজাপুর, পলাশী ফতেপুর, লক্ষ্মীনগর, পলাশী ফতেপুর (দক্ষিণাংশ) গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। প্রায় আড়াই শ বাড়ি নদীতে ভেঙে গেছে। তাঁরা নদীর দক্ষিণ তীরে বাংলাবাজার এলাকায় তাঁদের বসতি সরিয়ে নিয়ে গেছেন। এখন পর্যন্ত দুর্গত মানুষ কোনো ত্রাণসামগ্রী পাননি।

তলিয়ে যাওয়া সড়কে মানুষের চলাচল। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চকরাজাপুর ইউনিয়নে

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। আগের বছরও এই এলাকার দুই শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এরই মধ্যে ইউনিয়নের এক–তৃতীয়াংশ কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়েছে। এবারও ভাঙনের মুখে পড়েছে বাড়িঘর, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নেও চলছে পদ্মা নদীর ভাঙন। এই এলাকারও অনেকেই আতঙ্কে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নে প্রায় ২৫০, দুর্লভপুর ইউনিয়নে ৪ হাজার ৫০০ ও মনাকষা ইউনিয়নে প্রায় ৩৫০টি পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

রাজশাহী নগরের ওপারে পবা উপজেলার চর মাজারদিয়াড় এলাকায় কিছু ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেলেও এখনো সেখানে ভাঙন দেখা দেয়নি। রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের তথ্যমতে, নাটোরের লালপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার বিঘা জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া রাজশাহীর ৯ হাজার ৬৮১ বিঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৪ হাজার ৮৫৭ বিঘা ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। লালপুরের বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের নওশারা সুলতানপুর, চাকলা বিনোদপুর, দিয়াড়শংকরপুর, আরাজি বাকনাই, রসুলপুর, মোহরকয়া আংশিকসহ প্রায় ১৮টি চর এলাকা প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বেড়েছে। গতকাল সকালে পানি কিছুটা কমেছে। পদ্মার প্রবেশদ্বার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে গতকাল ভোর ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ২১ দশমিক ৫ মিটার। সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা এক সেন্টিমিটার কমে যায়। এ পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ২২ দশমিক ৫ মিটার। রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ৫ মিটার। গতকাল সকাল ৬টা ও সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৯ মিটার।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তরাঞ্চলীয় পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন, এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বেড়েছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। এর মধ্যে গতকাল চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে পানি কমেছে। ফলে ভাটিতেও পানি কমবে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিনে পানি কমতে পারে।