গ্রামের মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে বছর তিনেক লেখাপড়া করে দারিদ্র্যের জন্য আর লেখাপড়া করতে পারেননি মাসুম বিল্লাহ (২৪)। সংসারের অভাব দূর করতে স্থানীয় এক রাজমিস্ত্রির সহযোগী হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি। চার বছর আগে গাজীপুরের মাওনার নয়নপুর এলাকায় চলে যান তিনি। সেখানে থেকেই কাজ করছিলেন। স্বপ্ন ছিল টাকা জমিয়ে গ্রামের বাড়িতে একটি আধা পাকা ঘর তুলবেন। কিন্তু সেই স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দুটি গুলিতে নিভে গেছে তাঁর জীবনপ্রদীপ। তাঁকে হারিয়ে পরিবার এখন দিশাহারা।
নিহত মাসুম বিল্লাহ নেত্রকোনার দুর্গাপুর উপজেলার নলুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা সাইদুর রহমান ও মুর্শিদা আক্তার দম্পতির একমাত্র ছেলে।
স্বজন ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ছয় ভাই-বোনের মধ্যে মাসুম বিল্লাহ ছিলেন দ্বিতীয়। তিন বোনের বিয়ে হয়েছে। বাবা-মা, স্ত্রী ও ছোট দুই বোন নিয়েই মাসুমের সংসার ছিল। তাঁর বাবা সাইদুর রহমান একসময় অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করতেন। তবে বয়সের ভারে এখন আর কাজ করতে পারেন না। বছরখানেক আগে একই উপজেলার আমেনা আক্তারকে বিয়ে করেন মাসুম। তাঁর আশা ছিল টাকা জমিয়ে বাড়িতে একটি আধা পাকা ঘর তৈরি করার। সে অনুযায়ী মাসে মাসে আয়ের কিছু টাকা একটি প্লাস্টিকের ব্যাংকে জমাতেন। গত ২৮ জুলাই সকালে তিনি গাজীপুর থেকে সর্বশেষ বাড়িতে এসেছিলেন। বাড়ি করার ইচ্ছার কথা পরিবারের লোকজনদের জানিয়েছেন। ওই দিন সন্ধ্যায় আবার কর্মস্থলে চলে যান। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। আন্দোলনে সংঘর্ষের সময় গাজীপুরের মাওনা ব্রিজ এলাকায় গুলিবিদ্ধ হন মাসুম। এ সময় অন্য আন্দোলনকারীরা তাঁকে উদ্ধার করে ভালুকা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। খবর পেয়ে স্বজনেরা ওই দিন রাতে তাঁর লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যান। পরদিন সকালে জানাজা শেষে লাশ দাফন করা হয়।
একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে বাবা সাইদুর রহমান এখনো স্বাভাবিক হতে পারেননি। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বলেন, ‘আমার তো সবই শ্যাষ হইয়া গেছে। আমার অহন বাঁচন-মরণ সবই সমান। আমার ছেলে কার কী ক্ষতি করছিল? তার মাথায় ও পিঠে গুলি কইরা মারতে হইছে। সংসারের অভাব দূর করণের লাইগ্গা ছেলেডা গাজীপুর থাইক্কা রাজমিস্ত্রির কাম করত। আমি অভাগা বাপ। বাইচ্চা থাইক্কা ছেলের মৃত্যু দেখতে হইল। এই হত্যার বিচার হইব কি না, তা জানি না। তয় আল্লার কাছে বিচারের ভার দিলাম।’
মাসুমের মা মুর্শিদা আক্তারের আক্ষেপ আর আফসোস যেন শেষই হচ্ছে না। ছেলের এমন মৃত্যু মেনে নেওয়া তাঁর জন্য মোটেই সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘আমার একমাত্র ছেলেডারে এইবায় পক্ষীর মতো গুলি কইরা মারণ লাগছে? আমার বুক যারা খালি কইরা দিল, আল্লাহ তাআলা যেন এই খুনের বিচার করে। সব বিচারের মালিক আল্লাহ। আর কার কাছে বিচার চাইয়াম? আমার কলিজার টুকরা তো আর ফিরত আইব না। কত স্বপ্ন আছিল, আমার পুত একটা ঘর বানাইবো। সব শেষ হইয়া গেছে।’
মাসুম বিল্লাহর খালা সাবিনা আক্তার বলেন, ঘটনার দিন বেলা ৩টা ১০ মিনিটে মাসুম বিল্লাহর মোবাইল থেকে ফোন আসে। এক ব্যক্তি জানান, মাসুমের শরীরে গুলি লেগেছে, তিনি ভালুকা সরকারি হাসপাতালে আছেন। পরে একটি পিকআপ ভ্যান ভাড়া করে বাড়িতে লাশ নিয়ে আসা হয়। মাসুম মারা যাওয়ায় তাঁর পরিবার এখন খুবই বিপদে আছে। তাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ আর নাই। পাঁচ বোনের একমাত্র আদরের ভাই ছিলেন মাসুম।
দুর্গাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) এম রকিবুল হাসান বলেন, বৈষম্যবিরাধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত মাসুম বিল্লাহর পরিবারকে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে ২৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা করা হয়েছে। আরও সহযোগিতা করা হবে।
প্রতিবেশী তারা মিয়া বলেন, মাসুম বিল্লাহ খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। তিনি কোনো দিন এলাকায় কারও সঙ্গে মন্দ আচরণ করতেন না। হাসিমুখে কথা বলতেন। আন্দোলন করতে গিয়ে গুলিতে তিনি নিহত হয়েছেন। তাঁর পরিবারটি এখন খুবই বিপদে আছে। সরকার ও বিত্তবানদের উচিত পরিবারটির পাশে দাঁড়ানো।