একাধিক নাগরিক সংগঠন টোল আদায় বন্ধের দাবি জানিয়ে আসছে। এর মধ্যই আরও তিন বছরের ইজারা দেওয়া হয়েছে।
ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর ১৯৯১ সালে নির্মিত হয় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতু। স্থানীয় মানুষের কাছে শম্ভুগঞ্জ সেতু নামে পরিচিত এই সেতু নির্মাণের ৩৩ বছর পার হয়েছে। ইতিমধ্যে নির্মাণব্যয়ের চেয়ে অনেক গুণ বেশি টাকা টোল আদায় করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। একাধিক নাগরিক সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে সেতুর টোল আদায় বন্ধের দাবি জানিয়ে এলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। গত ২৫ জুন সেতুটির টোল আদায়ের জন্য নতুন করে আরও তিন বছরের ইজারা দেওয়া হয়েছে।
সওজ সূত্রে জানা যায়, ৫৬ কোটি ৩৮ লাখ ২৫০ টাকায় সেতুর ইজারা পেয়েছে ‘মেসার্স মোস্তাফা কামাল এন্টারপ্রাইজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। এর আগের তিন বছরও একই প্রতিষ্ঠান ইজারাদার ছিল। ওই তিন বছরের ইজারা মূল্য ছিল ৪৭ কোটি টাকা। এভাবে গত ৩৩ বছরে সেতুটির নির্মাণব্যয় ৭২ কোটি টাকা কবেই উঠে গেছে। এর পরও টোল আদায়কে স্থানীয় বাসিন্দারা জুলুম হিসেবে দেখছেন।
অন্তত ১৫ বছর ধরে একই ব্যক্তিরা বারবার টোল আদায়ের ইজারা পাচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মেসার্স মোস্তাফা কামাল এন্টারপ্রাইজের নামে এ ইজারা দেওয়া হলেও মূলত শম্ভুগঞ্জ এলাকার প্রভাবশালী কিছু মানুষ মিলে এ টোল আদায় করেন। টোলের ইজারা মূল্যের চেয়ে অনেক টাকা আদায় হয়। এ টাকা প্রভাবশালীরা ভাগ করে নেন।
এ বছর সেতুর ইজারার দরপত্র জমা দিতে না পেরে মাহবুবুল হক নামের এক ব্যবসায়ী পুলিশ ও সওজের কর্মকর্তাদের কাছে লিখিত অভিযোগে বলেন, দরপত্র জামা দিতে চাইলে সওজ কার্যালয়ের সামনে তাঁদের বাধা দেওয়া হয় ও দরপত্র ছিনিয়ে নেওয়া হয়।
তবে এ অভিযোগের তদন্ত করে সত্যতা পাওয়া যায়নি বলে দাবি ময়মনসিংহ কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈনউদ্দিনের। মেসার্স মোস্তফা কালাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘আমরা মোট ২৫ জন মিলে ইজারা নিয়ে টোল আদায় করি। কারও দরপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়ার কোনো বিষয় আমি শুনিনি।’
মাহবুবুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা দরপত্রে ইজারামূল্য ৫৭ কোটি টাকার বেশি দিয়েছিলাম। তবে আমাদের দরপত্র জমা দিতে দেওয়া হয়নি।’
সওজের ময়মনসিংহ কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী খাইরুল বাসার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ সঠিক নয়। আমরা মোট তিনটি দরপত্র পেয়েছি। সর্বনিম্ন দরদাতাকে আমরা বাছাই করেছি।’
নাগরিক আন্দোলনের নেতারা বলছেন, শম্ভুগঞ্জ সেতুর টোল আদায় বন্ধের দাবি আজকের নয়। ২০১৫ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের সামনের সড়কে পদচারী–সেতু উদ্বোধন করতে আসেন। ওই দিন নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে ওবায়দুল কাদেরের কাছে শম্ভুগঞ্জ সেতুর টোল আদায় বন্ধের দাবি জানানো হয়।
ময়মনসিংহের নাগরিক সংগঠন ‘জন–উদ্যোগ’-এর আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘নির্মাণব্যয় ওঠার পর টোল আদায় বন্ধ করা উচিত। আমরা অনেকবার এ সেতুর টোল আদায় বন্ধের দাবি জানিয়েছি। টোল আদায়ের কারণে শম্ভুগঞ্জ এলাকায় অনেক যানজটও হয়। অটোরিকশাচালকসহ বিভিন্ন ছোট যানবাহনের চালকের প্রতিবার পারাপারের সময় টোল দিতে হয়; যা তাঁদের জন্য খুবই কষ্টদায়ক।’
সওজের নির্বাহী প্রকৌশলী খাইরুল বাসার মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন বলেন, সেতুর টোল আদায় বন্ধ করার এখতিয়ার তাঁদের হাতে নেই।
গত রোববার সরেজমিনে জানা যায়, সেতুটির টোল হিসেবে প্রতিবার পারাপারের সময় বিভিন্ন ধরনের ট্রাক, বাস, প্রাইভেট কারসহ নানা প্রকারের যানবাহন থেকে আদায় করা হয় ২০ টাকা থেকে ২৫০ টাকা। এ ছাড়া সিএনজিচালিত ও ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা থেকে ১০ টাকা করে টোল আদায় করা হয়। বর্তমানে মোটরসাইকেল থেকে কোনো টোল আদায় করা হয় না।
সুমন মিয়া নামের একজন অটোরিকশাচালক বলেন, শম্ভুগঞ্জ বাজার থেকে ময়মনসিংহ শহর পর্যন্ত অটোরিকশায় যাত্রীপ্রতি ভাড়া ১০ টাকা। অল্প দূরত্বের এ পথে অনেক ইজিবাইক, ব্যাটারিচালিত রিকশা চলে। যে কারণে বেশি যাত্রী পাওয়া যায় না। অনেক সময় দুই থেকে তিনজন নিয়েও চলতে হয়। দুজন নিলে ভাড়া হয় ২০ টাকা। ওই ২০ টাকা থেকেও ১০ টাকা টোল দিতে হয়।
শম্ভুগঞ্জ বাজারে আরও কয়েকজন অটোরিকশাচালক বলেন, অনেক অটোরিকশা সারা দিনে অন্তত ১০ বার শম্ভুগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ শহরে যায়। আসা-যাওয়ায় ২০ বার সেতু পার হতে হলে ২০০ টাকা দিতে হয় টোল। সারা দিনে ২০০ টাকা টোল দেওয়ার পর সংসার খরচের জন্য তেমন কিছু থাকে না।
ময়মনসিংহ জেলা নাগরিক আন্দোলন ও উন্নয়ন সংগ্রাম পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন কালাম বলেন, ‘সংগঠনের পক্ষ থেকে একাধিকবার এ সেতুর টোল আদায় বন্ধের দাবি জানিয়েছি। এবার এ দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি দেওয়ার পরিকল্পনা করছি আমরা।’