এক যুগ পর ছেলেকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা মা–বাবা

বাবা ইসমাইল হোসেন ও মা কাজল বেগমের সঙ্গে ছেলে আবদুল্লাহ খায়রুল
ছবি: প্রথম আলো

এক সময়ের ইঞ্জিনচালিত ট্রলারের চালক বাক্‌প্রতিবন্ধী আবদুল্লাহ খায়রুলের বয়স এখন ৩৩ বছরের কাছাকাছি। এক যুগ আগে তিনি শ্বশুরবাড়িতে রওনা দিয়ে পথ হারিয়ে ফেলেন। ট্রাকে কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার নোয়াদ্দা গ্রামে আসেন। সেই থেকে তিনি নিখোঁজ ছিলেন। আজ শনিবার আবদুল্লাহ খায়রুলের বাবা মো. ইসমাইল ও মা কাজল বেগম হারানো ছেলেকে খুঁজে পেয়েছেন। দীর্ঘদিন পর নিখোঁজ ছেলেকে খুঁজে পেয়ে তাঁরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেছেন।

নোয়াদ্দা গ্রামের বাসিন্দা দোকানি ঝারু মিয়া প্রধান বাক্‌প্রতিবন্ধী আবদুল্লাহ খায়রুলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আজ শনিবার দুপুর ১২টায় মো. ইসমাইল ও মা কাজল বেগম ঝারু মিয়ার বাড়িতে আবদুল্লাহ খায়রুলকে নিয়ে যান।

বিয়ের ছয় মাস পর একদিন খায়রুল একা শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর পথ হারিয়ে ফেলেন। ভুলে পণ্যবাহী ট্রাকযোগে ঢাকা-পেন্নাই-মতলব সড়কের দাউদকান্দি উপজেলার নোয়াদ্দায় এসে নামেন।

নিখোঁজ আবদুল্লাহ খায়রুলের বাবা ইসমাইল হোসেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের আহমদপুর গ্রামের বাসিন্দা। ছেলে হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, তিন ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে খায়রুল বড়। খায়রুল একসময় গ্রামের খালে ইঞ্জিনচালিত ট্রলার চালাতেন। তবে কথা বলতে পারতেন না। সারা দিনই বাইরে কাটাতে চাইতেন। ঘরমুখী করার জন্য তাঁরা খায়রুলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদরের ইশেরনগর গ্রামের এক তরুণীর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দেন।

পালক বাবা ঝারু মিয়া ও পালক মা মিনারা বেগমের সঙ্গে আবদুল্লাহ খায়রুল

বিয়ের ছয় মাস পর একদিন খায়রুল একা শ্বশুরবাড়িতে রওনা দেন। কিছুদূর যাওয়ার পর পথ হারিয়ে ফেলেন। ভুলে পণ্যবাহী ট্রাকযোগে ঢাকা-পেন্নাই-মতলব সড়কের দাউদকান্দি উপজেলার নোয়াদ্দায় এসে নামেন। খায়রুল ট্রাক থেকে নামার পর চিৎকার করতে থাকেন। এ সময় দোকানদার ঝারু মিয়া প্রধান তাঁকে আশ্রয় দেন। পছন্দের খাবার খেতে দেন। নিজের সন্তানের মতোই লালন-পালন, আদর-যত্ন করেন।

সম্প্রতি খায়রুলের খালাতো বোন রেনুয়ারা আক্তারের স্বামী আশর মিয়া ভাঙারিসামগ্রী কিনতে দাউদকান্দির নোয়াদ্দা গ্রামে এসে খায়রুলকে দেখে চিনতে পারেন। পরে মুঠোফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে খায়রুলের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলান।

সম্প্রতি খায়রুলের খালাতো বোন রেনুয়ারা আক্তারের স্বামী আশর মিয়া ভাঙারিসামগ্রী কিনতে দাউদকান্দির নোয়াদ্দা গ্রামে এসে খায়রুলকে দেখে চিনতে পারেন। পরে মুঠোফোনে ভিডিও কলের মাধ্যমে খায়রুলের মা-বাবার সঙ্গে কথা বলান। এরপর আজ শনিবার দুপুরে খায়রুলের মা, বাবা, মামা, খালু, খালা ও ছোট ভাই নোয়াদ্দা গ্রামের আসেন। এ সময় উপস্থিত সবাই আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।

আবদুল্লাহ খায়রুলের বাবা ইসমাইল হোসেন বলেন, ‘আমার ছেলে খায়রুল বাক্‌প্রতিবন্ধী (বোবা)। শ্বশুরবাড়িতে রওনা দিয়ে নিখোঁজ হয়। দীর্ঘ ১২ বছর বিভিন্ন জায়গায় তাঁকে খুঁজেছি। এখানকার লোকজনের আশ্রয়ে এবং তাঁদের দেওয়া খাবার খেয়ে খায়রুল এত দিন বেঁচে আছে। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ।’

দীর্ঘ ১২ বছর পর ছেলের সঙ্গে মা-বাবার সাক্ষাতের খবরে নোয়াদ্দা এলাকার অসংখ্য নারী- পুরুষ-শিশু ভিড় জমাতে থাকে। স্থানীয় ব্যক্তিরা জানান, ১২ বছর আগে বর্ষার দিনে খায়রুল একটি পণ্যবোঝাই ট্রাক থেকে নেমে চিৎকার-চেঁচামেচি করছিলেন। এ সময় নোয়দ্দা গ্রামের বাসিন্দা দোকানদার ঝারু মিয়া প্রধান তাঁকে আশ্রয় দেন।

নোয়াদ্দা গ্রামের কৃষক আনোয়ার হোসেন বলেন, আবদুল্লাহ খায়রুল নোয়াদ্দা এলাকায় সবার কাছে পরিচিত মুখ। কথা বলতে না পারলেও শরীরে প্রচণ্ড রাগ ছিল। তার পারিবারিক নাম ছিল খায়রুল। কথা বলতে না পারায় এলাকাবাসী তার নাম রাখেন আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহ খায়রুল রাগের বশে এলাকার অনেকের সঙ্গে মারামারিতে জড়িয়ে পড়তেন। জিততে না পারলে ঝারু মিয়া প্রধানের স্ত্রী মিনারা বেগমকে মারধর করে রাগ সামলাতেন। অসুস্থ হলে চিকিৎসা করাতেন। নিজের সন্তানের মতো সেবা করতেন।

ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে দিনরাত কত যে চোখের পানি ফেলেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়
ইসমাইল ও কাজল বেগম, আবদুল্লাহ খায়রুলের বাবা-মা

মিনারা বেগম বলেন, ‘খায়রুল তাঁর মা-বাবাকে ফিরে পাওয়ায় আমার কষ্ট হলেও আজ আমি খুব খুশি।’ ঝারু মিয়া একই কথা বলেন।

ইসমাইল ও কাজল বেগম বলেন, ‘ছেলেকে খুঁজতে খুঁজতে দিনরাত কত যে চোখের পানি ফেলেছি, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’