কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন আশ্রয়শিবিরে সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতা বেড়েই চলেছে। গত সাত বছরে এসব আশ্রয়শিবিরে খুন হয়েছেন ২৪৬ জন রোহিঙ্গা নাগরিক। সাত বছরে একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি। গতকাল রোববার রোহিঙ্গা ঢলের সাত বছর পূর্তিতে একাধিক সমাবেশে রোহিঙ্গা নেতারা এসব কথা তুলে ধরে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তা নিশ্চিতের তাগিদ দেন।
গত সাত বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোতে মোট ৩ হাজার ৮২৩টি মামলাতে ৮ হাজার ৬৮৯ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। কিন্তু সাড়ে ১২ লাখ রোহিঙ্গার ভেতর থেকে আসামিদের চিহ্নিত করে গ্রেপ্তার করা কঠিন। বেশির ভাগ আসামি আশ্রয়শিবিরের বাইরে উখিয়া ও টেকনাফের গহিন পাহাড়ের আস্তানায় অবস্থান করছে বলে জানায় পুলিশ।
বর্তমানে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা সাড়ে ১২ লাখ। এর মধ্যে ৮ লাখ এসেছেন ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পরের কয়েক মাসে। রোহিঙ্গা নেতারা বলছেন, নিরাপত্তার স্বার্থে উখিয়া ও টেকনাফের ৩৩টি আশ্রয়শিবিরের চারদিকে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখা হলেও বর্তমানে শতাধিক স্থানে কাঁটাতার কেটে ফেলা হয়েছে। সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও), আরাকান স্যালভেশন আর্মিসহ (আরসা) রোহিঙ্গাদের ১৪টির বেশি সন্ত্রাসী বাহিনী সন্ধ্যার পর কাঁটাতারের ছেঁড়া অংশ দিয়ে আশ্রয়শিবিরে প্রবেশ করে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাচ্ছে। গত সাত বছরে আরসা সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ, ডিজিএফআই কর্মকর্তাসহ অন্তত দেড় শতাধিক রোহিঙ্গা নেতাকে হত্যা করলেও গোষ্ঠীর মূল হোতারা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। খুনের ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ রোহিঙ্গার পাশাপাশি শরণার্থী সেবা কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত অর্ধশতাধিক এনজিও-আইএনজিওর কর্মকর্তা–কর্মচারী নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। প্রাণনাশের আশঙ্কায় এনজিও কর্মচারীরা বিকেল চারটার আগেই আশ্রয়শিবির ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছেন।
বাড়ছে খুনখারাবি, তৎপর সশস্ত্র গোষ্ঠী
শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠীর টার্গেট কিলিং বেড়েছে। সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে সেখানে যৌথ বাহিনীর অভিযান চলমান আছে। প্রায় প্রতিদিন অস্ত্র, গোলাবারুদসহ সন্ত্রাসীরা ধরা পড়ছে।
আশ্রয়শিবিরগুলোতে খুনের ঘটনা ঘটেই চলেছে। সর্বশেষ ২৩ আগস্ট ভোররাতে উখিয়ার মধুরছড়া আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৪ বর্ধিত) আরএসও সন্ত্রাসীদের গুলিতে মো. ইসমাইল নামের এক রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়। তিনি ওই আশ্রয়শিবিরের বি-৬ ব্লকের রোহিঙ্গা মো. ইসমাইলের ছেলে। আরএসও ছেড়ে আরসায় যুক্ত হওয়ায় তাঁকে হত্যা করা হয়। ১৩ আগস্ট উখিয়ার বালুখালী আশ্রয়শিবিরে (ক্যাম্প-৮ পশ্চিম) আরসার গুলিতে খুন হয়েছেন আরএসও সমর্থক রোহিঙ্গা যুবক ফিরোজ খান (২৭)। ২০২১ সালে ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে আরসা সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন রোহিঙ্গাদের শীর্ষ নেতা মুহিবুল্লাহ (৪৮)। তিনি আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ) সংগঠনের চেয়ারম্যান ছিলেন। পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই হাবিবুল্লাহ বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে উখিয়া থানায় হত্যা মামলা করেন। ২০২৩ সালের ১৪ জুন কক্সবাজার আদালতে আরসার ২৯ জন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে উখিয়া থানা-পুলিশ। তবে নাম-ঠিকানা শনাক্ত না হওয়ায় অভিযোগপত্র থেকে আরসার প্রধান আতাউল্লাহ আবু আহাম্মার জুনুনিসহ সাতজনের নাম বাদ দেওয়া হয়।
মুহিবুল্লাহ খুনের এক মাস না পেরোতেই ২২ অক্টোবর বালুখালীর (ক্যাম্প-১৮) দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামা আল ইসলামিয়া মাদ্রাসা ও মসজিদে হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয় ছয়জন মাদ্রাসাশিক্ষক ও ছাত্রকে। এ ঘটনায় আরসাকে দায়ী করা হচ্ছে। চাঞ্চল্যকর এই দুটি হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আরসার তিনজন ক্যাম্প কমান্ডারসহ অন্তত ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করে এপিবিএন ও উখিয়া থানার পুলিশ।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা নেতাদের দেওয়া তথ্যমতে, গত আট মাসে আশ্রয়শিবিরে ৫১টি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় অন্তত ৬০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। অধিকাংশ খুনের ঘটনা আরসার সঙ্গে আরএসও এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে। সংঘর্ষে আরসার ২১ জন ও আরএসওর পাঁচজন নিহত হন।
মামলা হচ্ছে তবে গ্রেপ্তার কম
সাত বছরে আশ্রয়শিবিরগুলোয় একাধিক সন্ত্রাসী বাহিনীর মধ্যে গোলাগুলি এবং পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৪৬ জন। বিপরীতে মামলা হয়েছে ২৩৩টি। আসামি ১ হাজার ৬৪৮ জন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আরসা প্রধান আতা উল্লাহ আম্মার জুনুনী, নবী হোসেন বাহিনীর প্রধান ও ইয়াবা চোরাচালানের মূল হোতা নবী হোসেন। তবে আসামিদের ৭০ শতাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে।
গত এক বছরে আশ্রয়শিবিরে মাদক চোরাচালান বেড়েছে অনেক। বেকার রোহিঙ্গারা মাদক চোরাচালানসহ সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছেন। চলতি বছরের ৩১ জুলাই পর্যন্ত সাত মাসে মাদকের ১৬০টি মামলায় ২৪৩ জন রোহিঙ্গাকে আসামি করা হয়। ২০২৩ সালে মাদকের মামলা হয় ৪০৮টি। গত সাত বছরে মাদকের ২ হাজার ৪৭৯টি মামলায় ৩ হাজার ৭৭৬ জনকে আসামি করা হলেও অনেকে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহারও বাড়ছে আশ্রয়শিবিরে। গত সাত বছরে অস্ত্রের ৪০৯টি মামলায় ৮৫৬ জনকে আসামি করা হলেও চিহ্নিতদের অনেককে আইনের আওতায় আনা যায়নি। সন্ত্রাসীদের ধরতে গিয়ে পুলিশের ওপর হামলাও থেমে নেই। পুলিশ আক্রান্তের ৭টি মামলায় ৭৭ জনকে আসামি করা হয়।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এইচ এম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, এ পর্যন্ত আশ্রয়শিবিরে অভিযান চালিয়ে র্যাব আরসার শীর্ষ সন্ত্রাসী, সামরিক কমান্ডারসহ ১২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। ৫৮ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, ৭৮টি দেশি ও বিদেশি অস্ত্র, বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড, হ্যান্ড মাইন ও গুলি জব্দ করা হয়েছে।