শখের তোলা লাখ টাকা! সেই শখ পূরণ করতে লাখ টাকাই খরচ করলেন ৭০ বছর বয়সী খলিলুর রহমান। লাখ টাকা খরচ করে তিনি গড়ে তুলেছেন শখের কমলাবাগান। সেই বাগান এখন তাঁকে ফিরিয়ে দিচ্ছে লাখ লাখ টাকা।
খলিলুর রহমানের বাড়ি শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ তারাবনিয়া ইউনিয়নের মালকান্দি গ্রামে। বছর তিনেক আগে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত একটি জমিতে বালু ফেলে কমলার বাগান করেছেন তিনি। ৪০ শতাংশের ওই জমিতে লাগিয়েছেন ১৫০টি কমলাগাছ। গত বছর সেই গাছ থেকে এক লাখ টাকার কমলা বিক্রি করেন। এ বছর কমলা বিক্রি শুরু করবেন চলতি মাসের শেষ সপ্তাহে। আশা আছে এবার দুই লাখ টাকার বেশি বিক্রির।
সম্প্রতি মালকান্দি গ্রামে গিয়ে কথা হয় কৃষক খলিলুর রহমানের সঙ্গে। কীভাবে এই বাগান তিনি গড়ে তুলেছেন, সেই গল্প শোনালেন। খলিলুরের চার ছেলে। এর মধ্যে তিনজন থাকেন সৌদি আরব। আরেক ছেলেকে নিয়ে নিজেদের জমিজমায় ফসল ফলান তিনি। বছর তিনেক আগে তাঁর প্রবাসী এক ছেলে বিদেশে কমলা চাষের একটি ভিডিও পাঠান তাঁকে। এটি দেখে কমলার বাগান তৈরির শখ হয় খলিলুরের। কিন্তু বাগান করার জন্য যেমন জমির প্রয়োজন, তেমন জমি নেই তাঁর। সে জন্য বালু এনে বাড়ির পাশের ৪০ শতাংশ একটি পরিত্যক্ত নিচু জমি ভরাট করেন। নানা জায়গায় খুঁজে শেষে চুয়াডাঙ্গার একটি নার্সারি থেকে ১৫০টি কমলার চারা আনেন। এরপর কৃষি বিভাগের পরামর্শ নিয়ে বালুর মধ্যেই লাগিয়ে দেন সেসব চারা। সব মিলিয়ে তাঁর খরচ হয় প্রায় সাড়ে তিন লাখ টাকা।
শরীয়তপুর জেলার ওপর দিয়ে পদ্মা ও মেঘনা নদী প্রবাহিত হয়েছে। নদী দুটির অববাহিকায় ভেদরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ তারাবনিয়া ইউনিয়ন অবস্থিত। সেখানকার অধিকাংশ কৃষিজমি বালুময়। বছরের অর্ধেকটা সময় বর্ষার পানিতে তলিয়ে থাকে এসব জমি। এরপর বালুতে আবাদ করা যায়—এমন ফসলই ফলান কৃষকেরা। এ কারণে অধিকাংশ এলাকায় বেশির ভাগ সময়ই জমিগুলো অনাবাদি থাকে।
খলিলুর রহমানের বাগানটিও বালুর মধ্যে করেছিলেন তিনি। পরে কৃষি বিভাগের পরামর্শে প্রতিটি কমলার চারার চারপাশে দেড় ফুট গভীর করে বালু সরিয়ে তাতে জৈব সার দেন। প্রতিদিন সেচ দিতেন। বাগানের যত্ন সাধারণত তিনিই করেন। তবে শারীরিক কারণে একান্তই না পারলে ছেলে ও অন্য লোকজনের সাহায্য নেন। নিয়মিত যত্ন নেওয়ায় গত বছর ১১০টি গাছে কমলা ধরে। গাছগুলোয় উৎপাদিত প্রায় ৩০ মণ কমলা তিনি ১ লাখ টাকায় বিক্রি করেন। এবার জুনে ১৫০টি গাছে কমলার ফুল আসে। এখন প্রতিটি গাছের কমলায় পাকা রং ধরছে।
খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা কৃষক মানুষ। ফলন ঘরে আসার পর বুকটা প্রশান্তিতে ভরে যায়। বালুময় এ চরাঞ্চলে কমলার আবাদ করা ছিল দুঃস্বপ্ন ও অসম্ভব। কিন্তু চেষ্টা ও পরিশ্রম করলে সেই অসম্ভবকেও বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। এখন এ বাগান পুরো চরে সম্প্রসারণ করার স্বপ্ন দেখছি আমি।’
কৃষক খলিলুর রহমানের স্বপ্নের এই বাগান দেখতে প্রতিদিন অনেকেই আসেন। অনেকে গাছ থেকে কমলা কিনতে চান। কিন্তু নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের আগে কমলা বিক্রি করবেন না খলিলুর। গত শনিবার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাগানটি দেখতে এসেছিলেন উপজেলার রামভদ্রপুর এলাকার বাসিন্দা সোহাগ মৃধা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সিনেমায়-নাটকে কমলার বাগান দেখেছি। এখন বাস্তবে দেখার সুযোগ হলো। আমাদের বাড়ির কাছে চরাঞ্চলের বালুতে কমলার আবাদ হবে, তা কখনো ভাবিনি।’
তপ্ত বালুতে কমলা আবাদের মতো অসম্ভবকে কঠোর শ্রম ও আত্মবিশ্বাসে বয়োজ্যেষ্ঠ কৃষক খলিলুর রহমান সম্ভব করে তুলেছেন বলে মনে করেন দক্ষিণ তারাবনিয়া ইউনিয়নের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সার্বক্ষণিক তাঁকে পরামর্শ দিয়েছি। কখন কোন সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে হবে, তা বাগানে গিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি। খলিলুর রহমানের কমলার বাগানের সফলতার গল্প শুনে এখন ওই এলাকা ও অন্যান্য এলাকার কৃষকেরাও কমলার বাগান করায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন।’