নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও সেনবাগ উপজেলায় এখনো ছড়িয়ে আছে ধ্বংসযজ্ঞের নানা চিহ্ন।
হামলা-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ধ্বংসস্তূপ সরছে একটু একটু করে। শিক্ষার্থীরাই দায়িত্ব নিয়েছেন ধ্বংসের ক্ষত সারানোর। তাঁদেরই উদ্যোগে চলছে ধোয়ামোছার কাজ। পাশাপাশি সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো, জঞ্জাল সাফ করা আর গাছ লাগানোও চলছে। সব মিলিয়ে বিশাল এক কর্মযজ্ঞ।
তবে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের চিহ্ন মুছে ফেলতে সময় লাগবে। এখনো বাতাসে ভাসছে পোড়া গন্ধ। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও সেনবাগ উপজেলায় এখনো ছড়িয়ে আছে ধ্বংসযজ্ঞের নানা চিহ্ন।
গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সরেজমিনে দেখা যায়, জেলার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র চৌমুহনী চৌরাস্তার ব্যস্ততম সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে ব্যস্ত একদল শিক্ষার্থী। তাঁদের তৎপরতায় নিত্য যানজট লেগে থাকা চৌরাস্তা এলাকায় একেবারেই যানজটহীন। চৌরাস্তা মাড়িয়ে আনুমানিক ১০০ গজ এগোতেই সড়কের ডানে চোখ আটকে যায় চৌমুহনী পৌরসভার ভবনগুলোর দিকে। সেখানে কী পরিমাণ ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল, সেটি চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না কারও। পৌরসভার মূল ভবন, অডিটরিয়াম, গাড়ির গ্যারেজসহ তিনটি ভবনের প্রতিটিতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে গ্যারেজের ভেতরে ও বাইরে থাকা গাড়িগুলোতে।
চৌমুহনী পৌরসভা ভবন থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে চৌমুহনী রেলগেট এলাকায় জেলার অন্যতম একটি বিপণিবিতান। চৌমুহনী-ফেনী চার লেন সড়কের উত্তর পাশের এই বিপণিবিতানের মালিক নোয়াখালী-২ আসনের সদ্য বিলুপ্ত সংসদের সদস্য মোরশেদ আলম। তাঁর নামেই বিপণিবিতানটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মোরশেদ আলম কমপ্লেক্স’। ৫ আগস্টের বিজয় উৎসবের নামে হামলা-ভাঙচুর চালানো হয় এই বিপণিবিতানেও। ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা কাচগুলো পুনঃস্থাপন করে আগামী কাল শনিবার বিপণিবিতান খুলে দেওয়ার চেষ্টা করছেন।
বেগমগঞ্জের সীমানা পার হলেই সেনবাগ উপজেলার ছমিরমুন্সিরহাট বাজার। চৌমুহনী-ফেনী সড়ক হয়ে বাজারে ঢুকতেই সড়কের দক্ষিণ পাশের একটি বিশাল বিপণিবিতানের ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়ে। জাহাঙ্গীর আলম কমপ্লেক্স নামের বিপণিবিতানটিও রক্ষা পায়নি বিজয় উৎসবের হামলা থেকে। কমপ্লেক্সটির দুই পাশের সব কাচ ভেঙে দেওয়া হয়। কমপ্লেক্সটির মালিক উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম।
এত ধ্বংসস্তূপের মাঝেও ছমিরমুন্সিরহাট বাজারে বৃষ্টিতে ভিজে একদল শিক্ষার্থীর সড়ক পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন করা এবং সড়ক বিভাজকে গাছ লাগানোর কাজ করছিলেন। তাঁদের এই কর্মযজ্ঞ সাধারণ মানুষের মধ্যে আশার সঞ্চার করেছে। অনেককেই বলতে শোনা যায়, যারা মানুষের স্থাপনায় হামলা-ভাঙচুর চালিয়েছে, তারা সবাই সুযোগসন্ধানী। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যা করে দেখাচ্ছে, সেটি অনুকরণীয়।
শিক্ষার্থীদের তৎপরতায় প্রাণ ফিরে পাচ্ছে সোনাইমুড়ী থানা ভবন। গতকাল দুপুরে থানা ভবনের দিকে এগোতেই ফটকে দাঁড়ান আনসার সদস্য রাকিব। পরে গণমাধ্যমের কর্মী পরিচয় পেয়ে ভেতরে ঢোকার পথ করে দেন। ভবনের সামনে পোড়া কাগজপত্র ও অন্যান্য আসবাবের বিশাল ধ্বংসস্তূপ। পাশে সারিবদ্ধ অবস্থায় পড়ে আছে কয়েকটি পোড়া গাড়ি। ভবনের ভেতরের কক্ষগুলোর মেঝে পরিষ্কার করে আগুনে পোড়া ধ্বংসাবশেষ বাইরে স্তূপ করে রেখেছেন শিক্ষার্থীরা। ভবনের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখা যায়, আগুনের তাপে দেয়ালের পলেস্তারাগুলো খসে পড়েছে। চারদিকেই আগুনের পোড়া গন্ধ।
পরিদর্শনকালে এক তরুণকে দেখা যায়, লুট হওয়া কতগুলো গুলি নিয়ে এসেছেন থানায় জমা দিতে। জানালেন, থানার অদূরে একটি ঝোপের মধ্যে তিনি গুলিগুলো পেয়েছেন। তাই থানায় নিয়ে এসেছেন জমা দিতে। আনসার সদস্য রাকিব গুলিগুলো গুনে জমা রাখবেন।
সোনাইমুড়ী থানা থেকে প্রায় ৫০০ গজ দূরে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স। সরকার পতনের উৎসবের আগুনে জ্বলেছে ওই কমপ্লেক্সও। কমপ্লেক্সের ভেতরে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়সহ ১৩টি সরকারি দপ্তর ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে সেদিন। ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয় প্রতিটি দপ্তর। সেখানেও আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সোনাইমুড়ী শাখা এবং স্থানীয় একাধিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্য শিক্ষার্থীরা চারতলা উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্স ভবনের প্রতিটি ফ্লোর থেকে হামলা-ভাঙচুরের ধ্বংসাবশেষ সরিয়েছেন। এরপর প্রতিটি কক্ষ পানি দিয়ে ধুয়ে-মুছে দিয়েছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহসমন্বয়ক মাইনল হাসান বলেন, সবাই উৎসাহ নিয়ে নিজেকে দেশ গড়ার কাজে লাগিয়েছেন। তিনি বলেন, তাঁরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি প্রতিটি দপ্তরে বলে এসেছেন, ভবিষ্যতে কেউ যদি কোনো ধরনের ঝামেলা করতে আসে, তাৎক্ষণিক যেন তাঁদের জানানো হয়।