ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি টান হাবিবুর রহমান জালালের (৪৩)। চারপাশের সবুজ ও সোনালি ফসলেই তাঁর বাঁচা। একসময় জীবিকার সন্ধানে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তবে কয়েক বছর থেকে স্থায়ীভাবে দেশে আছেন এবং কৃষিতেই মজে আছেন। নতুন জাতের ধান চাষেই তাঁর আগ্রহ ও আনন্দ। অন্যরা যেখানে নতুন জাতের ধান চাষ নিয়ে সংশয়ে থাকেন, সেখানে তিনি সানন্দে নতুন জাতের ধান চাষে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন।
হাবিবুর রহমানের বাড়ি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার গিয়াসনগরে। বর্তমানে তাঁর সময় কাটে কৃষির নতুন প্রযুক্তি ব্যবহার ও নতুন জাত নিয়ে কাজ করে। লাভ-ক্ষতির কথা না ভেবেই গবেষকের মতো তিনি নতুন জাতের ধান চাষ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। চাষাবাদ তাঁর জীবিকার উৎস হলেও কৃষিতে নতুন কিছু খুঁজতেই তাঁর আনন্দ।
১১ অক্টোবর সকাল সাতটার দিকে গিয়াসনগরে গিয়ে ভিন্ন ধরনের ধানখেত চোখে পড়ে। ধানখেত গাঢ় কুয়াশার চাদরে ঢাকা। ধানের পাতায় ও শিষে জমে আছে শিশির। একটি খেতে পাতার আড়ালে উঁকি দেওয়া বেগুনি রঙের ধানে পাক ধরছে। সেখানে টাঙানো সাইনবোর্ডে লেখা ‘কোরিয়ান বেগুনি ধান’। অন্য খেতগুলোতে রঙিন ফিতা টানানো। বিভিন্ন ধরনের রঙিন বেলুন বাতাসে কাঁপছে। দেখে মনে হয় কোনো উৎসবের প্রাঙ্গণ। ধানখেত দেখতে দেখতেই কৃষক হাবিবুর রহমান বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর ট্রাকস্যুট, রেইনকোট ও মাথায় গোল টুপি পরা। দেখতে অনেকটা ভিনদেশি চাষির মতো। তাঁর সঙ্গে মাঠে ঢুকতেই একটি খেতে ‘ইন্দোনেশিয়ান কালো ধান’, একটি খেতে লেখা ‘ফাতেমা ধান-২’ সাইনবোর্ড চোখে পড়ে।
হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০২২ থেকে তিনি রঙিন ধান চাষ করছেন। এ জাতের ধান চাষে তাঁর আগ্রহ তৈরি হয়েছে অনলাইনে দেখে। বীজও সংগ্রহ করেছেন অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন চাষির কাছ থেকে। গত বছর দেশি-বিদেশি ১২ জাতের ধান চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে ইন্দোনেশিয়া, জাপান, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও কোরিয়ার ধান ছিল। এই পাঁচ জাতের সব কটি চাল কালো, নয়তো কালোর মতো। সব কটি জাতই ১০ থেকে ১৫ শতক করে জায়গাতে চাষ করেছিলেন।
হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ধান ভালোই মিলেছে। যদিও দেশি জাতের তুলনায় ফলন কম। শতকে ২০ কেজির মতো ধান উৎপাদন হয়েছে। কিন্তু এই জাতের মার্কেট ভ্যালু আছে। চাল বিক্রি করিনি। নিজেরা খেয়েছি। আত্মীয়স্বজনকে দিয়েছি। এবার নিজে খাওয়ার জন্য পাঁচ শতক করে দুই জাতের রঙিন ধান চাষ করেছি। ইন্দোনেশিয়ান কালো ধান ও কোরিয়ান বেগুনি ধান। ভালো রাইস মিল না থাকায় বাণিজ্যিকভাবে চাষে যেতে পারছি না। স্থানীয় রাইস মিলে চালের কালো আবরণ থাকে না, চাল অনেকটা সাদাটে হয়ে যায়। কালো রং না থাকলে চাল বেচতে সুবিধা হয় না।’
কোরিয়ান বেগুনি ধানে পোকামাকড়ের আক্রমণ নেই বললেই চলে বলে জানান হাবিবুর রহমান। তাঁর ভাষ্য, ইন্দোনেশিয়ান জাতেও পোকার আক্রমণ কম। তবে পাতা পোড়া রোগের আক্রমণ আছে। একটু সতর্ক থাকলে তেমন সমস্যা হয় না। এ ছাড়া ২০২১ সালে ফাতেমা জাতের ধান থেকে দুটি ছড়া আলাদা করে রেখেছিলেন। সেই ছড়া থেকে বীজ উৎপাদন করেছেন। গত বছর এই বীজে চাষ করেছেন। ভালো ফলন হয়েছে। প্রতি ছড়ায় ৮০০ থেকে এক হাজার ধান বা ৭০ থেকে ৮০ গ্রাম ধান পেয়েছেন। এবার ২০ শতক জমিতে দ্বিতীয়বার চাষ করেছেন। ভালো ধান হয়েছে। রোগ ও পোকার আক্রমণও কম। ধানও ১০০ থেকে ১০৫ দিনের মধ্যে পেকে যায়। গত বছরই তাঁর কাছে এই ধানের বীজ অনেকে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি দেননি। তিনি এবার চাষ করে এর ফলন ও সুবিধা-অসুবিধা নিশ্চিত হতে চাইছেন। এবার নির্বিঘ্নে ফসল তুলতে পারলে স্থানীয়দের মধ্যে এই জাতটির বীজ সরবরাহ করবেন। তাঁর কাজই হচ্ছে অন্যরা যেখানে নতুন জাত নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত থাকেন, তিনি সে ক্ষেত্রে লাভ-লোকসান নিয়ে ভাবেন না। নতুন কিছু পেলেই চাষ করেন, পরীক্ষা করেন, পর্যবেক্ষণ করেন।
হাবিবুর রহমানকে অগ্রগামী কৃষক বলে অভিহিত করেছেন কৃষি বিভাগের স্থানীয় উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা নিরোজ কান্তি রায়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইন থেকে নতুন জাত সম্পর্কে জেনে হাবিবুর রহমান ধান চাষ করেন। এতে সফলতার ভাগই বেশি। যত প্রযুক্তি আছে, তিনি প্রয়োগ করেন। সুষম সার, সুষম কীটনাশক ব্যবহার করেন। একজন গবেষক ধরনের মানুষ তিনি।
কৃষি উদ্যোক্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কৃষি আমার একটা শখ। ছোটবেলা থেকেই কৃষির প্রতি আগ্রহ। এখন এটা পেশা-নেশা। এতেই মোটামুটি আমার সংসার চলে যায়।’
এ বছর সাড়ে সাত কিয়ার (বিঘা) জমিতে বিভিন্ন জাতের ধান চাষ করেছেন হাবিবুর রহমান। এসব জমির মালিকদের কাছ থেকে বছরে ১৬ মণ ধানের বিনিময়ে ইজারা নিয়েছেন। রবি মৌসুমে এই জমিতে আলু, গম, শর্ষে, শাকসবজি, কালো টমেটোর চাষ করেন। এবার বাণিজ্যিকভাবে আলু চাষ করতে চাইছেন। তিনি যখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র, তখন থেকেই মধু চাষ করে আসছেন।
এ বছর তাঁর সাতটি মৌ-বাক্স আছে। বছরে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার মধু বিক্রি করেন। ২০০৬ সালে তিনি ওমান চলে গিয়েছিলেন। ২০১৮ সালে বাবা অসুস্থ হলে স্থায়ীভাবে দেশে ফিরে আসেন। বিদেশ যাওয়ার আগে পশুচিকিৎসা করতেন, তাঁর পশুর ওষুধের দোকান ছিল। দেশে এসে পুরোনো পেশাতে আর ফেরেননি। পুরোপুরি কৃষিতে মন দেন। স্ত্রী ও এক কন্যা নিয়ে সংসার। নতুন জাতের ধানের খোঁজ করে চাষবাদ করা কিংবা অন্য কোনো কৃষিপণ্য চাষাবাদে ব্যস্ত সময় কেটে যায় কৃষি অন্তপ্রাণ মানুষটির।