সব হারিয়ে ইউটিউবে দেখে গাড়ল পালনের শুরু, এখন ‘দুধে–ভাতে’ সংসার জাহিদুলের

গাড়ল ও ভেড়ার পাল চরাচ্ছেন খামারি জাহিদুল ইসলাম। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের চরঘাগুয়ায়
ছবি: প্রথম আলো

ইউটিউবে গানের ভিডিও দেখতে দেখতে গাড়ল পালনের এক ভিডিওতে চোখ আটকে যায় জাহিদুল ইসলামের (৪৫)। স্বল্প বিনিয়োগে সংকর জাতের গাড়ল পালনের ভিডিওটি কয়েকবার মনোযোগ দিয়ে দেখেন তিনি। এরপর মনস্থির করেন গাড়ল পালনের।

কিন্তু ঢাকায় রাজমিস্ত্রির জোগালির কাজ করা জাহিদুলের হাতে তখন মাত্র ২০ হাজার টাকা। এনজিও থেকে স্ত্রীর নামে আরও ৫০ হাজার টাকা ঋণ নেন। সেই টাকায় আটটি দেশি ভেড়া, আটটি ভেড়ার বাচ্চা ও একটি অস্ট্রেলিয়ান ডরপার জাতের গাড়ল কিনে খামার গড়েন বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর চরে।

সেটা পাঁচ বছর আগের কথা। গাড়ল পালন করে এখন সফল খামারি জাহিদুল। এ পর্যন্ত সোয়া চার লাখ টাকায় ৬০টি গাড়ল বিক্রি করেছেন। সেই টাকায় দায়দেনা শোধ করেছেন। এক মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। সন্তানদের পড়ালেখা ও সংসারের খরচ চালানো ছাড়াও নগদ জমিয়েছেন দেড় লাখ টাকা। তাঁর খামারে ছোট-বড় মিলে গাড়ল আছে ১১২টি। তাঁর এ সফলতার গল্প ছড়িয়ে পড়েছে যমুনার চরাঞ্চলে। শূন্য থেকে সফল খামারি জাহিদুলের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে চরের অনেক যুবক গাড়লের খামার করতে ঝুঁকেছেন।

জাহিদুল ইসলামের গাড়লের খামারটির অবস্থান সারিয়াকান্দির কাজলা ইউনিয়নের চরঘাগুয়ায়। আগে তাঁর বাড়ি ছিল জামালপুরের মাদারগঞ্জ উপজেলার গুনারীতলা ইউনিয়নের চরগোপালপুরে।

বগুড়া শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে সারিয়াকান্দির কালীতলা নৌঘাট। সেখান থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় যেতে হয় চরঘাগুয়া খেয়াখাটে। নৌকা নোঙর করে লোকালয়ের খোঁজে পা বাড়াতেই কাঁচা সড়কের পাশেই বিস্তীর্ণ চরে দেখা গেল, সবুজ ঘাসে চরানো গাড়লের পাল। পালের ভেতরে জমির আলে দুটি গাড়লের বাচ্চাকে ঘাস খাওয়াচ্ছেন জাহিদুলের স্ত্রী কুলসুম বেগম।

জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে গাড়লের দেখভাল করেন স্ত্রী কুলসুম বেগম

খেতের আলে দাঁড়িয়ে কথা শুরু হয় কুলসুম বেগমের সঙ্গে। কুলসুম বললেন, ‘চরগোপালপুরে বসতঘর ও খেতভরা ফসল—সব আছিল। লোকটার (স্বামী) মাথাত হঠাৎ বড়লোক হওয়ার ভূত চাপল। বসতভিটা, গরু সব বেইচা বিদেশ যাবার জন্যি আদম ব্যাপারীর হাতে দুই লাখ ট্যাকা তুইলা দিল। বিদেশ যাওয়া তো হইলোই না, বসতভিটা বেইচা মাথা গোঁজার ঠাঁইটাও হারাইলাম। শ্যাষে ছোট ছোট তিনডা সন্তান নিয়া এই চরে আসলাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘জীবনে ম্যালা কষ্ট করছি, রাত–দিন না খাইয়া থাকছি। ছোট ছোট ছলগুলাক মানুষের বাড়িত থিকা ভাতের মাড় চাইয়া আইনা খাওয়াইছি। দিনমজুর, রাজমিস্ত্রির কাম করছি। শ্যাষে ভাগ্য খুইলা দিছে এই গাড়লের খামার। এহন আমার দুধে-ভাতে সংসার।’

দুর্গম চরে পশুচিকিৎসকের তেমন দেখা মেলে না। কোনো গাড়লের সমস্যা হলে লক্ষণ দেখে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে সমাধান জেনে নেন। এরপর স্থানীয় বাজার থেকে ওষুধ এনে অসুস্থ গাড়লকে খাওয়ান জাহিদুল।

কুলসুমের সঙ্গে কথা বলার একপর্যায়ে সেখানে আসেন খামারি জাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, তাঁর বাবা লাল মিয়া ছিলেন যমুনার চরের দরিদ্র কৃষক। শৈশব থেকেই বাবার সঙ্গে খেতে কাজ করেছেন। সারা বছর মরিচ, শসা, পাট, কাউন, ভুট্টা, বাদামসহ চরের জমিতে নানা ফসল চাষ করতেন। অভাব থাকলেও ভালোই চলছিল তাঁর। আট বছর আগে হঠাৎ একদিন এক দালালের সঙ্গে পরিচয় হয়। শর্টকাটে বড়লোক হওয়ার লোভে পড়ে বসতবাড়ি-জায়গাজমি ছাড়াও সর্বস্ব বিক্রি করে বিদেশ যাওয়ার জন্য অর্থ জোগাড় করেন। নগদ দুই লাখ টাকা তুলে দেন সেই দালালের হাতে। পরে টাকা হাতিয়ে নিয়ে লাপাত্তা হন সেই দালাল। সব হারিয়ে জাহিদুল স্ত্রী ও তিন সন্তানের মুখে ভাত তুলে দিতে করেন দিনমজুরির কাজ। এরপর ইউটিউবে দেখে শুরু করেন গাড়ল পালন।

চরের সবুজ ঘাসে ছেড়ে দিলে দিনভর ঘাস খেয়ে খামারে ফেরে গাড়ল। সম্প্রতি বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার কাজলা ইউনিয়নের চরঘাগুয়ায়

জাহিদুলের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি মাদি গাড়ল বছরে গড়ে দুটি করে বাচ্চা দেয়। দ্রুত বংশবিস্তার করে বলে গাড়লের খামারে লাভও বেশি। ভেড়ার সঙ্গে সংকরায়ণ করা মাদি গাড়ল বাজারে প্রতিটি গড়ে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকায় বিক্রি হয়। সংকরায়ণ করা গর্ভবতী গাড়ল বিক্রি হয় ১৫ হাজার টাকায়। পুরুষ গাড়ল বিক্রি হয় প্রতিটি গড়ে ১৭ থেকে ১৮ হাজার টাকায়। গাড়লের মাংস প্রতি কেজি বিক্রি হয় গড়ে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। দুর্গম চরে পশুচিকিৎসকের তেমন দেখা মেলে না। খামারের কোনো গাড়লের সমস্যা হলে লক্ষণ দেখে ইউটিউবে সার্চ দিয়ে সমাধান জেনে নেন। এরপর স্থানীয় বাজার থেকে ওষুধ এনে অসুস্থ গাড়লকে খাওয়ান।

জাহিদুল বললেন, সারা দিন চরের সবুজ ঘাস খেয়ে বেড়ায় তাঁর খামারের গাড়লগুলো। গাড়ল খুবই নিরীহ প্রাণী। ভেড়ার চেয়েও স্বাস্থ্যবান হয় বলে গাড়েলের মাংসও বেশি হয়। এটি দেখতে অনেকটা দুম্বার মতো। চরের সবুজ ঘাসে ছেড়ে দিলে দিনভর ঘাস খেয়ে বেলাশেষে খামারে ফেরে। গাড়ল পালনের তেমন খরচ নেই। গাড়ল চরাতে সার্বক্ষণিক দেখভালের জন্য রাখালেরও প্রয়োজন হয় না। বাড়তি খাবার হিসেবে ভুসি, খইল ও ভাত খেতে দেন।

জাহিদুলের দেখাদেখি পাশের নব্বইচরের মুকুল হোসেন, চরঘাগুয়ার সাবলু মণ্ডল, চরবাটিয়ার আশরাফ আলীসহ অনেকেই গাড়লের খামার করে সফলতা পেয়েছেন। চরবাটিয়ার আশরাফ আলী ২০১৯ সালে ৩০টি গাড়ল দিয়ে খামার শুরু করেন। এই উদ্যোক্তার শুরুতে খরচ হয়েছিল লাখ দুয়েক টাকা। বর্তমানে তাঁর খামারে গাড়লের সংখ্যা ১২০। এর বাজারমূল্য প্রায় ১০ লাখ টাকা।

সারিয়াকান্দি পশুসম্পদ কর্মকর্তা শাহে আলম বলেন, গাড়লের আদিবাস ভারত ও নেপালে। এ উপজেলায় চরাঞ্চলে বাণিজ্যিকভাবে গাড়লের খামার শুরু করেছেন অনেকেই। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গাড়ল পালন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দিতে পারলে এর মাংস বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।