ডেঙ্গুতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ভাইকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি। মঙ্গলবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার খাটাসখৈল গ্রামে
ডেঙ্গুতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ভাইকে হারিয়ে স্বজনদের আহাজারি। মঙ্গলবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার খাটাসখৈল গ্রামে

ডেঙ্গু কেড়ে নিল বাবা-মায়ের স্বপ্ন, ভাইয়ের শোকে বোনের মৃত্যু

‘খেজুরগাছ লাগায়ে খুব কষ্টে ছেলি দুটাক মানুষ করছি। বড়টা গত বছর পড়া শেষ করি চাকরি পাইছে। ছোটটা (মুরাদ) মাসখানেক আগে ফাস্ট ক্লাস পেয়ে অনার্স পাস করিছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। কিন্তু চাকরি পাওয়ার আগেই আমাদের ছাড়ি ছোটটা চলি গেল। ওর সুখ দেখতে পারনুনি। ডেঙ্গু ওকে কাড়ি নিল। ওর মৃত্যুর খবর সহ্য করতে পারেনি চাচাতো বোন দোলেনা বেগম (৫০)। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে সে-ও মারা গেল।’

আজ মঙ্গলবার সকালে নাটোরের বড়াইগ্রাম উপজেলার খাটাসখৈল গ্রামের আবদুস সাত্তার মৃধা কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলছিলেন। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে তাঁর ছোট ছেলে মুরাদ আহমেদ মৃধা চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সোমবার মারা গেছেন। মুরাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী ছিলেন। সম্প্রতি স্নাতক পাস করে সরকারি চাকরির পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

আবদুস সাত্তার মৃধা প্রথম আলোকে বলেন, অন্যের খেজুরগাছ থেকে রস সংগ্রহ করে তিনি গুড় বানিয়ে বিক্রি করেন। গুড় বিক্রির টাকায় কোনোমতে সংসার চলে। বাড়িঘর করতে পারেননি। আয়ের টাকা দিয়ে দুই ছেলেকে পড়ালেখা করিয়েছেন। বড় ছেলে গত বছর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে একটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। ছোট ছেলে মুরাদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এক মাস আগে স্নাতক শেষ করেছেন। ছেলে প্রথম শ্রেণিতে পাস করায় পাড়ার সবাইকে মিষ্টি খাইয়েছিলেন।

সাত্তার মৃধা আরও বলেন, মুরাদ সবার কাছেই খুব প্রিয় ছিলেন। সোমবার তাঁর মৃত্যুর খবর শুনে মুরাদের চাচাতো বোন হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। হাসপাতালে নেওয়ার পর আজ ভোরে তিনিও মারা গেছেন।

মুরাদ আহমেদ মৃধা

মুরাদের স্বজনেরা বলেন, ২৬ জানুয়ারি বাড়িতে আসার পর মুরাদ জ্বরে আক্রান্ত হন। সঙ্গে বমি হচ্ছিল। স্থানীয় চিকিৎসককে দেখালে তিনি পরীক্ষা করাতে দেন। রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গু ধরা পড়ে। পাঁচ দিন চিকিৎসার পরও সুস্থ না হওয়ায় তাঁকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানে লিভার ও কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর ডায়ালাইসিস শুরু হয়। কিন্তু তাতেও সুস্থ হচ্ছিলেন না। স্বজনেরা শুক্রবার তাঁকে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানেও ডায়ালাইসিস করতে বললে আবার তাঁকে রাজশাহী মেডিকেলে নেওয়া হয়। গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো ডায়ালাইসিসে নেওয়া হলে অবস্থার অবনতি হয়। একপর্যায়ে সন্ধ্যায় মুরাদ মারা যান। রাতেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে সহপাঠীরা তাঁর লাশ নাটোরে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেন।

আজ সকালে খাটাসখৈল গ্রামে যেতেই মুরাদের জানাজার মাইকিং শোনা গেল। রাস্তার পাশে কাঁচা একটা বাড়ির আঙিনায় মুরাদের লাশের খাটিয়া রাখা। খাটিয়া ঘিরে নারী-পুরুষের ভিড়। আশপাশে আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা কান্নাকাটি করছেন। বাড়ির ভেতরে একটা বেঞ্চে বসে ছিলেন বাবা আবদুস সাত্তার মৃধা ও মা মিনা বেগম। ডেঙ্গুতে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেকে হারিয়ে তাঁরা বাক্‌রুদ্ধ হয়ে পড়েছেন।

আবদুস সাত্তার মৃধা চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ‘আমার তো সব শেষ। আমি আর কী বলব?’ মা মিনা বেগম বলেন, ‘আমরা মূর্খ মানুষ। ছেলে কী রোগে মারা গেল, কিছুই বুঝতে পারছিনি। কাকে বলব, কার কাছে পরামর্শ নিব, কিছুই ঠিক করতে পারিনি। শুধু ওকে লিয়া দৌড়াদৌড়ি করছি। কিন্তু কিছুতেই ভালো করতে পারিনি।’

মুরাদের স্কুলশিক্ষক অনিল ফ্রান্সিস রোজারিও। মুরাদকে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত তিনি পড়িয়েছেন। মুরাদের বাড়িতেই তাঁর সঙ্গে কথা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওকে নিজের ছেলের চেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। আমার ছেলের রেজাল্ট হলে আমি নিজে দেখতাম না। কিন্তু ফল বের হলে আমি নিজে ওর ফলাফল দেখতাম। আমি স্বপ্ন দেখতাম, মুরাদ দেশের একজন বড় কর্মকর্তা হবে।’

মুরাদের কলেজশিক্ষক রুহুল আমীন বলেন, ‘মুরাদ আমার খুব প্রিয় ছাত্র ছিল। টানা তিন বছর ওকে পড়িয়েছি। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। কিন্তু ওর সঙ্গে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়নি। কদিন আগেও ফোন করে আমার খোঁজখবর নিয়েছে। ওর মতো ভদ্র ও বিনয়ী ছাত্র পাওয়া মুশকিল।’