ফুলকপি দামে ধস নেমেছে। হতাশা দেখা দিয়েছে চাষিদের মধ্যে। সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটে
ফুলকপি দামে ধস নেমেছে। হতাশা দেখা দিয়েছে চাষিদের মধ্যে। সম্প্রতি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটে

মহাস্থান হাটে ফুলকপি-মুলার কেজি ২ টাকা, খরচও উঠছে না কৃষকের

বগুড়ায় সব ধরনের শীতকালীন সবজির দামে ধস নেমেছে। পাইকারি পর্যায়ে এক কেজি মুলা, ফুলকপি ও নতুন পেঁয়াজের ফুলকা দুই টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। দুই সপ্তাহের ব্যবধানে তিন থেকে চার গুণ হয়েছে শিম, বাঁধাকপি, কাঁচা মরিচ, বেগুন, মিষ্টি লাউ, বরবটিসহ বিভিন্ন সবজির দাম। কমেছে নতুন আলুর দামও। সস্তায় সবজি বিক্রি করে উৎপাদন খরচ উঠছে না কৃষকের। পুঁজি হারিয়ে দিশাহারা অবস্থা চাষিদের।

কৃষকেরা বলছেন, চড়া দামে সার, বীজ, কীটনাশক কিনে তাঁরা সবজি চাষ করেছেন। এক কেজি মুলা ও ফুলকপি চাষ করতে খরচ পড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। অথচ দুই সপ্তাহ ধরে শীতকালীন সব সবজির দামে ধস নেমেছে। মুলা ও ফুলকপি মাত্র দুই টাকা দরে বিক্রি হয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এবার খেতে ব্যাপকভাবে সবজি উৎপাদন হয়েছে। উৎপাদিত সবজি একসঙ্গে খেত থেকে বাজারে আসছে। চাহিদার তুলনায় হাটে সবজির সরবরাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দামে ধস নেমেছে।

দেশে সবজির অন্যতম বড় পাইকারি মোকাম মহাস্থান হাট। এখান থেকে রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন শহর ও এলাকায় সবজি সরবরাহ করা হয়। গতকাল রোববার ও আজ সকালে সরেজমেনি হাটজুড়ে শীতকালীন সবজির পসরা দেখা যায়। হাটে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ফুলকপি ও মুলা ২ টাকা, আড়াই কেজি ওজনের বাঁধাকপি প্রতিটি ১২ টাকা, প্রতি কেজি মিষ্টি কুমড়া ১৬ টাকা, শিম ২০ টাকা, টমেটো ৪০ টাকা, দেশি নতুন আলু ৪৫ টাকা, ডায়মন্ড আলু ৩৫ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ৩০ টাকা, পেঁয়াজের ফুলকা ৪ টাকা, বেগুন ২৫ টাকা, করলা ৪০ টাকা, পেঁপে ২০ টাকা, শসা ৩৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ৩০ টাকা, গাঁজর ৩০ টাকা, পটোল ৩৫ টাকা, ছাঁচি লাউ প্রতিটি ৩০ টাকা, মিষ্টি লাউ প্রতি কেজি ১৬ টাকা ও বরবটি ২০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

দুই সপ্তাহ আগে মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি নতুন দেশি আলু ৭৫ টাকা, ডায়মন্ড আলু ৭০ টাকা, প্রতি কেজি ফুলকপি ২২ টাকা, দুই কেজি ওজনের বাঁধাকপি প্রতিটি ২২ টাকা, মিষ্টিকুমড়া প্রতি কেজি ২৪ টাকা, শিম ৪০ টাকা, মুলা ১২ টাকা, টমেটো ৬৫ টাকা, বেগুন ৪০ টাকা, করলা ৫৫ টাকা, পেঁপে ২৫ টাকা, শসা ৪০ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ৭৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ৪০ টাকা, গাঁজর ৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

নতুন পেঁয়াজের ফুলকা ও টমেটো। রোববার সকালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটে

মহাস্থান হাটের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শীতকালীন সবজিতে হাট ভরপুর। ভরা মৌসুমে নতুন আলুর সরবরাহ বেড়েছে। চাহিদার তুলনায় হাটে সবজির সরবরাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় দামে ধস নেমেছে।

মহাস্থান হাট কাঁচা ও পাকা মাল আড়তদার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম বলেন, এবার কৃষকের খেতে ব্যাপকভাবে সবজি চাষ হয়েছে। চাষিরাও ফলন ভালো পেয়েছেন। খেত থেকে সবজি তুলে চাষিরা বিক্রির জন্য একসঙ্গে হাটে নেওয়ায় সরবরাহ অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এতে দাম পড়েছে। তিনি আরও বলেন, দু-এক সপ্তাহের মধ্যে বাজারে আলুর প্রচুর সরবরাহ বাড়বে। এতে সবজি ও আলুর দাম আরও পড়ে যেতে পারে।

মহাস্থান হাটে ১০ মণ ফুলকপি বিক্রি করতে আসা শিবগঞ্জ উপজেলার উথলি গ্রামের কৃষক তরিকুল ইসলাম বলেন, ‘এক বিঘা জমিনত ফুলকপি লাগাচি। খরচ হচে ২৬ হাজার টেকা। খেতত ফুলকপির ফলন হচে ৩ হাজার ৪০০ কেজি। খেতত থ্যাকে ফুলকপি তুলে হাটত লিতেই পরিবহন খরচ পড়িচে গড়ে ২ টেকা। হাটত এক কেজি ফুলকপি বেচে দাম পাচি ২ টেকা। খ্যাতের ফুলকপি বেচে কোনোরকমে পরিবহন খরচ তুলবার পারলেও উৎপাদন খরচ উটপি না। বিঘায় ২৬ হাজার টেকা খরচের পুরাটায় গচ্চা।’

এবার জেলায় ৫৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু ও ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার রেকর্ড সবজি উৎপাদিত হয়েছে।
মতলুবর রহমান, উপপরিচালক, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর
নতুন পেঁয়াজের ফুলকা পাওয়া যাচ্ছে। রোববার সকালে বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার মহাস্থান হাটে

গত বছরের শীত মৌসুমে (ডিসেম্বরে) মহাস্থান হাটে সবজির সরবরাহ তুলনামূলক কম ছিল। পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের সবজির দাম ছিল আকাশছোঁয়া। মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে এক কেজি বেগুন গত মৌসুমে বিক্রি হয়েছে ৬০ টাকায়। নতুন পাকাড়ি জাতের আলু ৬০ টাকা ও সাদা জাতের আলু ৫৫ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। গত বছরের এ সময় প্রতি কেজি ফুলকপি ৬০ টাকা, বাঁধাকপি গড়ে ১০ টাকা, করলা ৬০ টাকা, বেগুন ৬৫ টাকা, টমেটো ৫৫ টাকা, পটোল ৫৫ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০ টাকা ও মিষ্টিকুমড়ার কেজি ছিল ৩৫ টাকা।

দাম কমেনি খুচরা বাজারে

মহাস্থান হাটে পাইকারি পর্যায়ে সব ধরনের শীতকালীন সবজির দামে ধস নামলেও বগুড়া শহরের খুচরা বাজারে এখনো চড়া দামেই বিক্রি হচ্ছে সবজি। রোববার বিকেলে শহরের ফতেহ আলী বাজারে প্রতি কেজি নতুন দেশি আলু ৬০ টাকা, ডায়মন্ড আলু ৫৫ টাকা, ফুলকপি ১২ টাকা, মুলা ১৬ টাকা, দুই কেজি ওজনের বাঁধাকপি প্রতিটি ২৫ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৪০ টাকা, শিম ৪০ টাকা, টমেটো ৭০ টাকা, নতুন পেঁয়াজ ৬০ টাকা, ফুলকা ২৫ টাকা, বেগুন ৬০ টাকা, করলা ৮০ টাকা, পেঁপে ৪০ টাকা, শসা ৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৫০ টাকা, গাঁজর ৬০ টাকা, পটোল ৬০ টাকা, ছাঁচি লাউ প্রতিটি ৫০ টাকা ও বরবটি ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে।

বাজার করতে আসা মাটিডালি এলাকার ফারুকুল হাসান বলেন, মহাস্থান হাটে এক কেজি মুলা ও ফুলকপি দুই টাকা বিক্রি হলেও বগুড়ার বাজারে এই মুলা ও ফুলকপি ১৫ টাকা কেজির কমে মিলছে না। ১২ কিলোমিটারের ব্যবধানে এক কেজি মুলা ও ফুলকপির দাম আট গুণ বেশি দামে বিক্রি করছেন খুচরা বিক্রেতারা।

মিষ্টিকুমড়া ৩৫ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। রোববার সকালে মহাস্থান হাটে

সবজির দোকানি মতিউর রহমান বলেন, মহাস্থান হাটে সব ধরনের সবজি কম দামে বিক্রি হলেও খুচরা বাজারে এখনো তেমন প্রভাব পড়েনি। কারণ, এখানকার সবজির সরবরাহ আসে রাজা বাজারের পাইকারি মোকাম থেকে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মতলুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, এবার জেলায় ৫৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে আলু ও ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে শীতকালীন সবজি চাষ হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার রেকর্ড সবজি উৎপাদিত হয়েছে। এ ছাড়া মৌসুমের শুরুতে সব ধরনের সবজির ভালো দামও পেয়েছেন চাষিরা। বাজারে সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় দাম কিছুটা পড়ে গেলেও কৃষকের লোকসান হওয়ার কথা নয়। কারণ, খেতের কিছু সবজি কৃষক আগেভাগে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছেন। এখন কম দামে বিক্রি করলেও উৎপাদন খরচ আগে উঠে যাওয়ার কথা।