একবার খেলে মুখে স্বাদ লেগে থাকে অনেকক্ষণ। সাধারণ দইয়ের সঙ্গে মাখন আর পনির মেশালে খেতে যেমন লাগবে, এই দই অনেকটা সেই স্বাদ এনে দেয় মুখে। আর হাত দিয়ে যদি কেউ এই দই খান, তবে এর ঘন ননি দূর করতে ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে। এই দইয়ের নাম ইলিশিয়ার মহিষের দই। কক্সবাজারের চকরিয়ার লাল ব্রিজ এলাকায় পাওয়া যায় এই দই।
কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার পূর্ব বড় ভেওলা ও পশ্চিম বড় ভেওলা—এই দুই ইউনিয়নের ঠিক মাঝে লাল ব্রিজ এলাকার অবস্থান। প্রশ্ন হলো, এসব দই লাল ব্রিজ এলাকায় পাওয়া গেলেও নাম কেন ইলিশিয়ার দই? উত্তর জানতে চাইলে এখানকার দই বিক্রেতারা বলেন, ইলিশিয়া এলাকাটি লাল ব্রিজ থেকে অন্তত চার-পাঁচ কিলোমিটার দূরে। ৩০-৪০ বছর আগে শুধু ইলিশিয়া এলাকায় মহিষের দই পাওয়া যেত। তখন থেকেই এই এলাকার মহিষের দইয়ের সঙ্গে ইলিশিয়ার নাম যুক্ত হয়ে যায়। তবে এখন দইয়ের কারখানা বা দোকান—সবই লাল ব্রিজ এলাকায়। লাল ব্রিজ এলাকার ১২–১৫টি দইয়ের দোকান থেকে প্রতিদিন চকরিয়া সদর, কক্সবাজার, পেকুয়া ও চট্টগ্রামে এক হাজার হাঁড়ির মতো দই সরবরাহ করা হয়। এ ছাড়া ক্রেতারাও দূরদূরান্ত থেকে এসে কিনে নেন।
চকরিয়া সদরের থানা রাস্তার মাথা থেকে আট কিলোমিটার দূরে লাল ব্রিজ এলাকায় যাওয়া যায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও চকরিয়া-বদরখালী রুটের বাসে। আজ বুধবার সকাল সাতটার দিকে অটোরিকশায় সেখানে পৌঁছে দেখা গেল এত সকালেও দইয়ের দোকানে ক্রেতা-বিক্রেতাদের ব্যস্ততা।
এই এলাকার ছোট একটি দোকানের নাম ‘ওয়াহিদ দই বিতান’। দোকানের সামনে টেবিল পেতে বসানো হয়েছে দইয়ের হাঁড়ি। তাতে ছোট ও বড় হাঁড়ির মুখ ঢেকে রাখা হয়েছে কাগজ দিয়ে। দোকানের ভেতরেও অন্তত দেড় থেকে দুই শ দইয়ের হাঁড়ি রয়েছে। খাঁটি মহিষের দইয়ের সন্ধানে এখানে শহর থেকে অনেকেই আসেন। তেমনই একজন চট্টগ্রাম শহর থেকে আসা নুরুল কবির। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বলছিলেন, ‘দেখবেন, দইটা যেন ভালো হয়!’ তাঁর কথা শুনে দোকানমালিক ওয়াহিদুল ইসলাম ছোট হাঁড়িটা নিয়ে চামচ দিয়ে নেড়ে দেখালেন। বললেন, ‘ইলিশিয়ার মহিষের খাঁটি দই। কোনো দুই নম্বরি নেই। এক ফোঁটা পানিও পাইবেন না। হাত দিয়া খাইলে সাবান দিলেও তেল যাইব না।’
ওয়াহিদ দই বিতানের মালিক ওয়াহিদুল ইসলাম ছয় বছর ধরে দই বিক্রি করছেন। তিনি জানান, গরম পড়লে দইয়ের চাহিদা বেড়ে যায়। গরম পড়ছে তাই দোকানে বিক্রিও বেশি। বিয়েশাদি মিলিয়ে সারা বছরই দইয়ের চাহিদা থাকে। এখন গড়ে প্রতিদিন তাঁর দোকান থেকে ১৫০-২০০ হাঁড়ি দই বিক্রি হয়।
ওয়াহিদুল বলেন, লাল ব্রিজ এলাকা থেকে প্রতিদিন অন্তত এক হাজার হাঁড়ি দই বিক্রি হচ্ছে। সারা বছরই দই বিক্রি হয়। তবে রমজানে চাহিদা বাড়ে। তখন দৈনিক দেড় হাজারের বেশি হাঁড়ি দই বিক্রি হয়ে থাকে।
ছোট ও বড়—দুই ধরনের হাঁড়িতে দই বিক্রি হয় এখানকার দোকানগুলোতে। হাঁড়ির আকারভেদে দইয়ের দামও ভিন্ন। হাঁড়িসহ ১ হাজার ২০০ গ্রামের দই ২৫০ টাকায় আর ২ হাজার ২০০ গ্রামের দই ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়।
এই দোকানের পাশেই কিছু দূরত্ব রেখে পরপর অনেকগুলো দইয়ের দোকান। সব মিলিয়ে ১২ থেকে ১৫টির মতো হবে। এলাকার বেশির ভাগ মানুষই মহিষ লালনপালন করেন। তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, পূর্ব বড় ভেওলা, পশ্চিম বড় ভেওলা, সাহারবিল, ঢেমুশিয়া ও চিরিংগা ইউনিয়নে অন্তত দুই হাজারের বেশি মহিষ রয়েছে। এলাকার দুই থেকে তিন শ মানুষ মহিষের খামার করেন। কারও বড় খামার, কারও ছোট আকারের। কেউ একটি বা দুই-তিনটি মহিষও পালন করেন। সেসব মহিষের দুধ থেকেই তৈরি হয় ইলিশিয়ার দই।
ইলিশিয়ার দই ফ্রিজে রাখতে হয় না। দই কিনতে আসা পেকুয়ার রাজাখালীর একটি স্কুলের গণিতের শিক্ষক ছোটন কান্তি সুশীল জানান এই তথ্য। তিনি বলেন, ‘এখানকার দই অত্যন্ত ভালো মানের। আমি অন্তত দুই বছর ধরে এখান থেকে দই কিনছি। এক হাঁড়ি দই কিনে তিন-চার দিন রেখে খাওয়া যায়। ফ্রিজ লাগে না।’
তবে এখানকার বড় সমস্যা চিংড়িঘের আর লবণের মাঠ। ঘের আর লবণের মাঠ যত বাড়ছে, ততই কমছে মহিষের চারণভূমি। এ কারণে ইলিশিয়ার দইও হুমকির মুখে পড়তে পারে ভবিষ্যতে। কয়েকজন মহিষের খামারি বলেন, মহিষের চারণভূমি আগের চেয়ে কমে গেছে। গড়ে উঠেছে চিংড়িঘের ও লবণের মাঠ। এ কারণে মহিষও কমে গেছে। ১০ বছর আগেও এ অঞ্চলে অন্তত ৪-৫ হাজার মহিষ ছিল। এভাবে চলতে থাকলে মহিষ থাকবে না।