ইঁদুরের গর্তে জমির ধান, কৃষকেরা ক্ষতিগ্রস্ত

মৌলভীবাজার জেলার মানচিত্র
মৌলভীবাজার জেলার মানচিত্র

ধানের ফলন ভালো হয়েছে। তাতে কৃষকের মন ভালো হওয়ারই কথা। কিন্তু কোনো কোনো ধানখেতের কাছে গিয়ে অনেক কৃষকের মন ভেঙে গেছে। ইঁদুর ধানগাছ কেটে ও ধানের ছড়া কেটে নিয়ে গর্ত ভরেছে। এভাবে এক কিয়ার (বিঘা) জমিতে দুই-তিন শতকের ধান নষ্ট করেছে ইঁদুর। এতে সেসব জমিতে যতটা ফসল পাওয়ার প্রত্যাশা কৃষকের, সেটা তাঁরা পাচ্ছেন না।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলার খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুর বন্দ (মাঠ), মোস্তফাপুর ইউনিয়নের খাইঞ্জার হাওর, রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওর-সংলগ্ন এলাকার জমিতে ইঁদুর ধান কেটে কৃষকের ক্ষতি করেছে। অনেকেই ইঁদুর মারতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের পরামর্শমতো খেতে ওষুধ দিয়েছেন, তাতে তেমন লাভ হয়নি।

সদর উপজেলার শেরপুরের মো. নূরুল ইসলাম সম্প্রতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতিতে চাষ করেছি। ধানও ভালো হয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে দুই কিয়ার জমিতে চার থেকে পাঁচ শতক জমির ধান ইঁদুর কেটে নষ্ট করেছে। ইঁদুর থেকে ফসল রক্ষা করতে অনেকেই অনেক রকম ওষুধ ব্যবহার করেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।’ তিনি জানান, তাঁর তিন কিয়ার জমিতে ফসল ফলাতে জমি তৈরি, হালচাষ, সার-বীজ, আগাছা পরিষ্কারসহ আনুষঙ্গিক খরচ হয়েছে প্রায় ২৩ হাজার টাকা। স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শমতো ইঁদুর তাড়াতে দুর্গন্ধযুক্ত বিস্কুট খেতে ছিটানো হয়েছে, তাতে লাভ হয়নি। ইঁদুর মাঠ ছাড়েনি। নির্জন সময়ে ইঁদুর সক্রিয় হয়ে ওঠে।

স্থানীয়ভাবে জানা গেছে, শেরপুরের নজরুল ইসলাম তাঁর দুই কিয়ার জমিতে ধান পেয়েছেন ১৮ মণের মতো। এই জমিতে যে রকম ফসল হয়েছে, তাতে কম করেও তাঁর ৩০ মণ ধান পাওয়ার কথা। একই অবস্থা আরও অনেক কৃষকের। একই গ্রামের (শেরপুর) মুস্তাকিন মিয়া, গৌছ মিয়াসহ অন্য কৃষকদেরও ক্ষতি করেছে ইঁদুর।

গ্রাম শেরপুরের কৃষক দুধ মিয়া বলেন, ‘ইঁদুর তো আমরারে রাখিয়া দের না (আমাদের রাখতেছে না)। ধুম কাটা দের (অবাধে ধান কাটছে)। কালা (কালো) বড় বড় একেকটা ইন্দুর (ইঁদুর)। কাঁচা-পাকনা সব ধানই কাটের। গোছা কালা ওয়া থাকি (ধান রোপণের পর থেকে) কাটা শুরু করে, ধান পাকা ওয়া (হওয়া) পর্যন্ত কাটের। খালি (শুধু) আমার না। হকল মাইনষর (সব মানুষের) একই অবস্থা।’

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, হাওর, বিল ও জলাশয়-সংলগ্ন স্থানে ধান রোপণের পর থেকেই ইঁদুর আক্রমণ শুরু করে। ধানের গোছা কাটে, সেই কাটা গোছা থেকে নতুন করে কুশি দিচ্ছে। ইঁদুর আবার সেই কুশিও কেটে ফেলছে। যে জায়গায় ধান কাটে, তার কাছাকাছি স্থানেই আবার কাটা শুরু করে। মানুষের চলাচল আছে এমন জমিতে, আইলের কাছে ধানগাছ কাটে কম। খেতের মধ্যে যেখানে সচরাচর লোকজনের যাওয়া-আসার সুযোগ কম, সেখানেই বেশি ধান কেটে থাকে। ধান কাটার পর সেই ধানগাছ সম্পূর্ণ মরে যায়। অনেক কৃষকই কৃষি বিভাগের স্থানীয় কর্মকর্তাদের পরামর্শ অনুযায়ী বিষমাখা গম, দুর্গন্ধযুক্ত বিস্কুট খেতে ছিটিয়ে দিচ্ছেন। কালো রঙের বড় আকারের একেকটি ইঁদুর। অনেকে রাতের বেলা মাঠে গিয়ে ইঁদুরকে তাড়াও করেন। কিন্তু ইঁদুর খুব একটা সরে না। ইঁদুরের দাঁতে বিভিন্ন জমির ধান কাটা পড়ছে। ইঁদুর ধানের ছড়া কেটে গর্তে নিয়ে যাচ্ছে। ধান ভালো হওয়া সত্ত্বেও ইঁদুরের কারণে বিভিন্ন জমিতে কিয়ারে আট-নয় মণের বেশি ধান মিলছে না। যেখানে ন্যূনতম ১৫-১৬ মণ ধান পাওয়ার কথা। প্রতি কিয়ারে তিন থেকে চার শতক জমির ধান নষ্ট করছে ইঁদুর। এই ইঁদুর এখন স্থানীয় কৃষকদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আতঙ্কের কারণ হয়ে গেছে। এ ছাড়া সদর উপজেলার মোস্তফাপুর ইউনিয়নের খাইঞ্জার হাওরেও ইঁদুরের উপদ্রব অনেক। রাজনগর উপজেলার কাউয়াদীঘি হাওরপারের পাঁচগাঁও এলাকাতেও ইঁদুরের উপদ্রব রয়েছে।

খলিলপুর ইউনিয়নের শেরপুর ব্লকের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা ইকবাল হাসান জালালী বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের জেলা কার্যালয়ে ইঁদুর দমনে চাষিদের নিয়ে সেমিনার করেছে। ইঁদুর শস্যের ক্ষতি করছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর মৌলভীবাজারের উপপরিচালক কৃষিবিদ সামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘ইঁদুর দমনে আমাদের অভিযান চলছে। ওষুধ দিয়ে, ফাঁদ দিয়ে যে যেভাবে পারে, সেভাবে ইঁদুর মারতে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। ইঁদুর ধানের গাছ কাটে, ধানের ছড়া কেটে ধান গর্তে নিয়ে যায়। জেলার সদর, রাজনগরসহ বিভিন্ন স্থানে বিল বা জলাভূমির আশপাশের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হচ্ছে।’