হাওরের পতিত জমি থেকে মিষ্টিকুমড়া তুলে এনে বিক্রির জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি খালিয়াজুরির জগন্নাথপুরে
হাওরের পতিত জমি থেকে মিষ্টিকুমড়া তুলে এনে বিক্রির জন্য স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সম্প্রতি খালিয়াজুরির জগন্নাথপুরে

পতিত জমিতে সবজি চাষ

নেত্রকোনার খালিয়াজুরির নূরপুরবোয়ালি এলাকার শাহ মো. সোয়েব মিয়া ঢাকায় একটি কারখানায় চাকরি করতেন। করোনা শুরুর বছরখানেক পর চাকরি হারিয়ে তিনি বাড়িতে চলে আসেন। আর মদন উপজেলার গোবিন্দশ্রী গ্রামের মো. হাইদুল মিয়া স্থানীয় বাজারে মুদির দোকানদার ছিলেন। করোনা শুরুর পর তাঁর ব্যবসায় ধস নামে। দুই বছর ধরে তিনিও বাড়িতে এসে বেকার জীবন কাটান। এবার হাওরে পতিত জমিতে তাঁরা মিষ্টি কুমড়া চাষ করে প্রথমবারেই বাজিমাত করেন, দেখছেন লাভের মুখ।

তাঁদের মতো অনেকেই লাউ, মরিচ, গোল আলু, মিষ্টি আলু, বাদাম, শর্ষে, ভুট্টা, ক্ষীরাসহ সবজি চাষ করে লাভবান হচ্ছেন।

হাইদুল মিয়া বলেন, ‘কৃষি বিভাগের পরামর্শে আধুনিক পদ্ধতিতে লাউ ও মরিচ চাষ শুরু করছি। প্রথমবারেই আমি সফলতার মুখ দেখছি। যে টেহা (টাকা) খরচ হইছে, আগাম সবজি বিক্রি কইরা তা এখন উইঠা গেছে। কিছু টেহা লাভ হইতাছে। আমার চাষ দেইখ্খা গ্রামের অনেকেই সবজি চাষে মন দিতাছেন।’ নূরপুর বোয়ালি গ্রামের সোয়েব মিয়াও প্রায় একই কথা জানান।

স্থানীয় বাসিন্দা, উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২৮৬ দশমিক ৮৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের খালিয়াজুরি ও ২২৫ দশমিক ৮৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মদন উপজেলায় ছোট–বড় প্রায় ৯৪টি হাওর রয়েছে। বছরের প্রায় সাত মাস পানিতে নিমজ্জিত থাকে এসব হাওর। হাওরে একমাত্র ফসল বোরো ধান। প্রায় ৩ লাখ ১৫ হাজার জনসংখ্যার দুটি উপজেলায় কৃষিজমির পরিমাণ প্রায় ৫২ হাজার হেক্টর। এর মধ্যে মদনে দুই ফসলি জমির পরিমাণ ১০ হাজার ৩৫০ হেক্টর, খালিয়াজুরিতে শুধু ৪৪৫ হেক্টর। আর অন্য জমিগুলো এক ফসলি। কয়েক বছর আগেও হাওরে এসব এক ফসলি জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ করতেন কৃষকেরা। কোনো বছর ভালো ফলন হলে তাঁরা লাভবান হন। আবার অকালবন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাথায় হাত পড়ে। এভাবেই পরিবার-পরিজন নিয়ে হাওরাঞ্চলের কৃষকেরা আনন্দ-বেদনায় জীবনযাপন করেন। এবার অধিকাংশ কৃষকই অনাবাদি জমিতে সবজি চাষে ঝুঁকছেন। অবশ্য তিন বছর ধরে হাওরে সবজি চাষ শুরু হলেও এবার পরিধি বাড়ছে।

খালিয়াজুরির কৃষি কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন জানান, তাঁর উপজেলার নূরপুরবোয়ালি, রসুলপুর, জগন্নাথপুর, খালিয়াজুরি সদর, লেপসিয়া, চাকুয়া, পাঁচহাট, মেন্দিপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় অন্তত ৪৪০ হেক্টর জমিতে সবজি চাষ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৬৫ হেক্টর জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। এ পর্যন্ত উৎপাদিত হয়েছে ৫ হাজার ৭০০ মেট্রিক টন। আরও ২০০ মেট্রিক টন উৎপাদনের আশা রয়েছে। এসব মিষ্টিকুমড়ার বাজারমূল্য প্রায় সাড়ে ১৪ কোটি টাকা।

মদন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আহসান হাবিব বলেন, মদনে হাওরের ৫০ হেক্টর জমিতে লামিয়া, ওয়ানাডার বল, ব্ল্যাক সুইট, সন্ধানী, শীলা ইত্যাদি জাতের মিষ্টিকুমড়া চাষ করা হয়। বেশি চাষ হয়েছে তিয়োশ্রী, গোবিন্দশ্রী, মাঘান, ফতেপুর এলাকায়। ফলন বেশি ও আগাম জাতের এসব সবজি চাষ করে কৃষকেরা ভালো লাভবান হচ্ছেন।

খালিয়াজুরির আসাদপুর গ্রামের কৃষক মজিবর রহমান বলেন, ‘আমি কয়েকজনরে সাথে লইয়া ৬০ একর খেতে মিষ্টি লাউ চাষ করছি। পর্যন্ত ৫৫ লাখ টেহার লাউ বিক্রি কইরা দিছি। আশা করি ভালা লাভ হইবো।’

মদনের তিয়োশ্রী গ্রামের খোকন মিয়া বলেন, ‘আমার জন্মের পর হাওরে সবজি চাষ দেখিনি। দুই–তিন বছর ধরে অনেকেই সবজির চাষে ঝুঁকছেন। এই এক ফসলির হাওরে সবজি উৎপাদনে এক নতুন বিপ্লব ঘটে যাচ্ছে। আগে শহর থেকে হাওরে সবজি আসত। এখন হাওর থেকে সবজি যাচ্ছে শহরে।’