ছাত্রজীবন থেকে ইচ্ছা ছিল উদ্যোক্তা হওয়ার। স্ত্রী, সন্তান ও মা–বাবাকে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে থাকতেন। করোনার সময় মা মারা যাওয়ার পর বদলে যায় সব। পরিবার ও বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শেই শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে যান কাইছার খান সিদ্দিকী (৪৩)। শুরু করেন সুপার অর্গানিক ফার্টিলাইজার নামে জৈব সারের খামার। বর্তমানে তাঁর খামারে একবারে প্রায় ২০০ টন সার উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। সার বিক্রি করে বছরে প্রায় ৫ লাখ টাকা আয় করেন কাইছার।
লোহাগাড়া উপজেলা সদর থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক হয়ে ৭ কিলোমিটার দক্ষিণে গেলেই চুনতি শাহ সাহেব গেট। সেখান থেকে চুনতি ইসহাক মিয়া সড়ক হয়ে ৩০০ মিটার ঢুকলেই হাতের ডানে সুপার অর্গানিক ফার্টিলাইজার খামারটির অবস্থান। কাইছার খান সিদ্দিকীর বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে ২০ শতক জায়গার ওপর অবস্থিত খামারটি।
সম্প্রতি সরেজমিনে খামারে গিয়ে দেখা যায়, পাঁচজন পুরুষ ও তিনজন নারী শ্রমিক খামারে কাজ করছেন। শ্রমিকদের কেউ কেউ ক্রাশিং মেশিনে সার গুঁড়া করছেন। আবার কেউ কেউ নিটিং মেশিনে সার পরিষ্কার করে চটের বস্তায় প্রক্রিয়াজাত করছেন।
খামারে কথা হয় কাইছার খান সিদ্দিকীর সঙ্গে। তিনি জানান, অর্ডার অনুযায়ী সার উৎপাদন করা হয়। বর্তমানে তিনি গড়ে প্রতিবার ৫০ টন সার উৎপাদন করেন। লোহাগাড়া ছাড়াও বান্দরবান ও কক্সবাজারের কিছু অঞ্চলের কৃষকেরা সারের অর্ডার দেন। প্রতি কেজি সার উৎপাদনে খরচ হয় ৬ টাকা, বিক্রি হয় ১০ টাকায়। যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে ৫০ টন সার বিক্রি করে লাভ হয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। দিন দিন কৃষকদের কাছে জৈব সারের চাহিদা বাড়ছে। কাইছারের আশা, সামনে উৎপাদন বাড়বে। আয়ও বাড়বে।
২০২১ সালের শুরুতে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (গাজীপুর) থেকে বিনা মূল্যে ১ মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রথমবারের মতো জৈব সার তৈরির কাজ শুরু করেন কাইছার। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ৫ হাজার কেজি সার উৎপাদন করেন। কিন্তু তা মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের আঞ্চলিক গবেষণাগারের ল্যাব টেস্টে ব্যর্থ হয়। হাল ছেড়ে না দিয়ে পরের বার আবারও উৎপাদন শুরু করেন। দ্বিতীয়বারে সফল হন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। এই সার কম খরচে অধিক ফলন দেওয়ায় সুফল পাচ্ছেন কৃষকেরা। কৃষকদের কাছে কাইছারের জৈব সারের চাহিদা বেড়েছে। ফলে সারের উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।
উপজেলার চুনতি মুন্সেফ বাজার এলাকার কৃষক মঈন উদ্দিন প্রথম আলোকে, ‘আমি ৩ বছর ধরে জমিতে জৈব সার ব্যবহার করছি। রাসায়নিক সারের তুলনায় এই সারের স্থায়িত্ব বেশি। তাই ফসল উৎপাদনের খরচ কম হচ্ছে। এতে আমরা লাভবান হচ্ছি।’
কাইছারের উৎপাদিত জৈব সারের নাম ট্রাইকো কম্পোস্ট সার। গরুর গোবর, রক্ত, মাছ ও সবজির উচ্ছিষ্ট, মুরগির বিষ্ঠা, কচুরিপানা, হাড়ের গুঁড়া, ছাই ও নিম খৈল প্রভৃতি জৈব উপাদান এবং ট্রাইকোডারমা ছত্রাকের অণুজীব নির্দিষ্ট অনুপাতে একত্রে মিশিয়ে তা স্তূপ করে ৩০ থেকে ৪০ দিন রেখে পচনপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই কম্পোস্ট সার তৈরি করা হয়। লোহাগাড়ার বিভিন্ন হাটবাজার, কসাইখানা ও খামার থেকে সারের জৈব উপাদানগুলো সংগ্রহ করা হয় বলে জানান কাইছার। পরে কেঁচো সারেও সফলতা লাভ করেন তিনি।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে ৮০০ গ্রাম আফ্রিকান কেঁচো প্রণোদনা হিসেবে পান কাইছার। সেগুলো দিয়ে ৩ শতক জায়গায় কেঁচো সার উৎপাদন শুরু করেন। বর্তমানে সেখানে ৭টি বেডে ২০ হাজার কেঁচো আছে আছে বলে জানান তিনি। বাসি গোবর খেয়ে কেঁচো মল ত্যাগ করে এবং এর সঙ্গে কেঁচোর দেহ থেকে রাসায়নিক পদার্থ বের হয়ে সার তৈরি হয়। এতে সময় লাগে ৪০ থেকে ৫০ দিন। খরচ বাদে সার বিক্রি করে প্রতিবারে আয় হয় ২০ হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি কেজি কেঁচো বিক্রি করে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা পান।
সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পে রাসায়নিক সারের পাশাপাশি জৈব সারের ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে বলে মনে করেন কাইছার। তিনি বলেন, রাসায়নিক সারে সরকারি ভর্তুকি থাকে ৭৫-৮৫ শতাংশ। সেই তুলনায় জৈব সারে কোনো প্রকার ভর্তুকি নেই। জৈব সারে যদি সরকারিভাবে অন্তত ২৫ শতাংশ ভর্তুকি দেওয়া হয় তাহলে কৃষি খাতে বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। কৃষকের চাষাবাদে খরচ কমবে অনেক। মাটির উর্বরতা শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
জৈব সারের উপকারিতা সম্পর্কে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কাজী শফিউল ইসলাম বলেন, ‘জৈব সার সব ধরনের ফসলে যেকোনো সময়ে ব্যবহার করা যায়। এটি মাটির গুণগত মান ঠিক রাখে, পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং প্রায় সব পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে। তাই সবজি এবং কৃষিজমিতে ৩-৪ মেট্রিক টন প্রতি হেক্টরে ও ফল গাছে গাছপ্রতি ৫-১০ কেজি হারে ব্যবহার করার জন্য কৃষকদের আমরা পরামর্শ প্রদান করি। এ ছাড়া মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, জৈব সার ব্যবহারে মাঠ ফসলে ফলন শতকরা ৫ থেকে ১৫ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (গাজীপুর) ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এম নাজিম উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, জৈব সারই হলো আগামী দিনের কৃষি। এই সার ব্যবহারে উৎপাদন দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাবে। এই সার মাটির স্বাস্থ্য বজায় রাখে, তা ছাড়া যে সব বর্জ্য পরিবেশকে দূষণ করে, তা রিসাইকেল করে জৈব সার উৎপাদন করা হচ্ছে। এভাবে জৈব সার পরিবেশ রক্ষায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। আমদানি নির্ভর রাসায়নিক সারে সরকারকে ভর্তুকি বাবদ প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয়। জৈব সারের সামগ্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে।