১৯৭১ সালের ১২ এপ্রিল রংপুর নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে তাঁদের গুলি করে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
১৯৭১ সালে জিকরুল হক ছিলেন তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে ‘বড় ভাই’ বলে সম্বোধন করতেন। তিনি ছিলেন একাধারে একজন চিকিৎসক, শিক্ষানুরাগী, সংস্কৃতিসেবী ও সমাজসেবী। ২৫ মার্চ কালরাতে তাঁকে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের কোয়ার্টার গার্ডে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। তাঁর ওপর নেমে আসে বর্বরোচিত নির্যাতন। ১২ এপ্রিল রংপুর সেনানিবাস এলাকার পাশে নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে ব্রাশফায়ারে তাঁকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী।
জিকরুল হকের ছেলে মুজিবুল হক বঙ্গবন্ধু পরিষদ সৈয়দপুর জেলা শাখার সভাপতি। স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘তৎকালীন নীলফামারী মহকুমার মধ্যে সৈয়দপুর নির্বাচনী এলাকাটি ছিল ভয়াবহ স্থান। বিহারি-অধ্যুষিত এ জনপদে বেশির ভাগ অবাঙালি নেতা ছিলেন আওয়ামী লীগবিদ্বেষী। তবে আমার বাবা ছিলেন একজন অপ্রতিদ্বন্দ্বী রাজনীতিবিদ। ১৯৫৪ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে বাবা সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে বিপুল ভোটে জয় পান।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় জিকরুল হকের মতো নীলফামারীর সৈয়দপুরে অনেক বুদ্ধিজীবীকে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসরেরা নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে। প্রজন্ম ’৭১ সংগঠনের সৈয়দপুর সাংগঠনিক জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও শহীদের সন্তান মহসিনুল হক বলেন, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সৈয়দপুরের বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা তৈরি হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তৎকালীন কায়েদে আজম কলেজে (বর্তমান শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ) এক সভা ডাকেন অধ্যক্ষ মতিন হাশমী। ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সৈয়দপুর পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ইজহার আহমেদসহ এলাকার চিহ্নিত রাজাকাররা। ওই সভায় একটি তালিকা তৈরি করা হয়। তালিকাটি দেওয়া হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে।
শহীদ বুদ্ধিজীবী শামসুল হকের সন্তান সৈয়দপুর সরকারি কলেজের সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সাখাওয়াৎ হোসেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সৈয়দপুরে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়, তাঁর বাবা ছিলেন ওই কমিটির আহ্বায়ক। পরিস্থিতি খারাপ হলে ২৩ মার্চ তাঁর পরিবারের সদস্যরা সৈয়দপুর শহর ছেড়ে পাশের গ্রাম ধলাগাছে চলে যান। রংপুর রোডে (বঙ্গবন্ধু সড়ক) শহরের বাড়িতে কেবল থেকে যান তাঁর চিকিৎসক বাবা। ২৮ মার্চ পাকিস্তানি বাহিনী তাঁর বাবাকে বাসা থেকে বন্দী করে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যায়।
সৈয়দপুর থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন বদিউজ্জামান। তাঁর নাতি প্রকৌশলী এ কে এম রাশেদুজ্জামান বলেন, সৈয়দপুর শহরের পুলিশ ফাঁড়ির পাশে তাঁর দাদার একটি ডিসপেনসারি ছিল। তিনি সেখানে বসে রোগী দেখতেন আর আন্দোলন–সংগ্রাম নিয়ে কথা বলতেন। মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নিতেন তাঁর দাদা। তখন এ শহরে আওয়ামী লীগের পক্ষে রাজনীতি করা ছিল অত্যন্ত দুরূহ ব্যাপার। তবে তাঁর দাদা নির্ভীক ছিলেন।
শিল্পপতি তুলসীরাম আগরওয়ালা আন্দোলন চালিয়ে নিতে ওই সময় মুজিব ফান্ডে এক লাখ টাকা দান করেছিলেন। তাঁর নাতি নারায়ণ আগরওয়ালা বর্তমানে ভারতের শিলিগুড়িতে বসবাস করছেন। মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, ২৫ মার্চ রাতে সৈয়দপুর শহরের মাড়োয়ারিপট্টির বাসভবনে দরজার কড়া নাড়ে পাকিস্তানি বাহিনী। কর্মচারীরা দরজা খুলে দিতেই বাড়ির ভেতর ঢুকে পড়ে একদল সেনাসদস্য। তুলসীরাম ও তাঁর ছেলে রামেশ্বর লাল আগরওয়ালাকে ধরে নিয়ে যায় তারা। অতঃপর দীর্ঘদিন সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে নির্মম নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল রংপুরের নিসবেতগঞ্জ বধ্যভূমিতে নিয়ে হত্যা করে।
বাড়িতে দুপুরে গোসল করছিলেন ন্যাপের সৈয়দপুর থানা শাখার সভাপতি এস এম ইয়াকুব। দিনটি ছিল ২৭ মার্চ। ভেজা শরীরে তাঁকে তুলে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তাঁর ছোট মেয়ে ইশরাত জাহান বলেন, ‘বাবা গান লিখতেন। সুরও দিতেন। গানের বাণীতে থাকত প্রতিবাদের ভাষা।’
শহীদ আয়েজ উদ্দিন ছিলেন স্বাধীনচেতা মানুষ। সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে বাড়িতে তিনি ২৩ মার্চ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে দেন।
আয়েজ উদ্দিনের মেয়ে আসমা আলী বলেন, ‘৩১ মার্চ রাতে সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্টে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর তুমুল যুদ্ধ চলে। সেদিন অনেক বাঙালি সেনাসদস্য পাকিস্তানিদের গুলিতে মারা যান। অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন। পাকিস্তানি বাহিনী ১ এপ্রিল আমাদের পরিবারের সবাইকে বন্দী করে। বাবাকে আলাদা করে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। অমানুষিক নির্যাতনের পর ১২ এপ্রিল তাঁকে হত্যা করা হয়। প্রিয়জন হারানোর এই বেদনা তাঁদের সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।’