সড়ক দুর্ঘটনায় আবুল কালমের স্ত্রী নুর জাহান বেগম, বড় মেয়ে কাজলরেখা ও কাজলরেখার ছেলে আবদুল্লাহ আনাসের মৃত্যু হয়
সড়ক দুর্ঘটনায় আবুল কালমের স্ত্রী নুর জাহান বেগম, বড় মেয়ে কাজলরেখা ও কাজলরেখার ছেলে আবদুল্লাহ আনাসের মৃত্যু হয়

স্ত্রী–মেয়েকে হারানো ষাটোর্ধ্ব কালাম ঘুমাতে পারেন না

ষাটোর্ধ্ব আবুল কালাম এখন ঠিকমতো ঘুমাতে পারেন না। খাওয়াদাওয়াও তেমন নেই। স্ত্রী-মেয়ের কথা মনে পড়লেই কাঁদেন।

গত ১৫ অক্টোবর হঠাৎ এক ঝড়ে তাঁর জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। সেদিন দুপুরে দাওয়াত খেতে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন তাঁর স্ত্রী, দুই মেয়ে, জামাতা ও সাত মাস বয়সী নাতি। পথে ট্রাকের ধাক্কায় মৃত্যু হয় তিনজনের। এর পর থেকে আহাজারি থামছে না এই বাবার।

আবুল কালামের বাড়ি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার দক্ষিণ বগাচতর এলাকায়। সড়ক দুর্ঘটনায় তাঁর স্ত্রী নুর জাহান বেগম, বড় মেয়ে কাজলরেখা ও কাজলরেখার ছেলে আবদুল্লাহ আনাসের মৃত্যু হয়। গুরুতর আহত হন ছোট মেয়ে ও জামাতা। এখন এই দুজনকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাসা, বাসা থেকে হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি করতে হচ্ছে তাঁর।

গত বুধবার যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো কান্না থামছিল না আবুল কালামের। তিনি বলছিলেন, আত্মীয়ের বাড়িতে দাওয়াতে স্ত্রী-মেয়েরা যাচ্ছিলেন। গন্তব্য ছিল মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়া ইউনিয়নের পূর্ব খৈয়াছড়া এলাকায়। পথে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের রাস্তার মাথা এলাকায় তাঁদের অটোরিকশায় ধাক্কা দেয় একটি বেপরোয়া ট্রাক। মুহূর্তেই সবকিছু ওলটপালট হয়ে যায়।

সেদিন বেলা একটার পরপর বেজে ওঠে কৃষক আবুল কালামের মুঠোফোন। ওপাশ থেকে তাঁর জামাতা ফোনে বলেছিলেন, ‘বাবা, অ্যাকসিডেন্ট হইছে। দ্রুত আসেন।’ তারপর বাড়ি থেকে ৩০ মিনিটের পথ পাড়ি দিয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছান আবুল কালাম।

সেদিনের ঘটনার বিষয়ে প্রথম আলোকে আবুল কালাম বলেন, যাওয়ার আগে তাঁর স্ত্রী ভাত-তরকারি রান্না করে গিয়েছিলেন। তিনি গরুকে খাবার দিয়ে খেতে বসবেন। ওই মুহূর্তে ফোনটা আসে। তিনি গিয়ে দেখেন, সবাই রক্তাক্ত। ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনজন।

স্বজন হারানো আবুল কালাম

এখন নাতির ছবির দিকে তাকাতে পারেন না আবুল কালাম। নাতি ও মেয়ে যে ঘরে থাকতেন, সেখানে আর কেউ যান না। ঘরটিতে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে আছে নাতি আনাসের শার্ট, প্যান্ট, শখ করে কেনা খেলনা।

আবুল কালাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আত্মীয়ের বাড়ির জন্য নতুন জামাকাপড়, মিষ্টি, বিস্কুটসহ নানা উপহার নিয়ে রওনা দিয়েছিলেন সবাই। তিনি নিজেই গাড়িতে তুলে দেন। কথা ছিল, সন্ধ্যার আগে আগে সবাই ফিরবেন। কিন্তু সেটি হলো না।

সেদিন অটোরিকশায় ছিলেন আবুল কালামের ছোট মেয়ে কামরুন্নাহার। দুর্ঘটনায় তিনিও আহত হন। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্নাতকের এই শিক্ষার্থী প্রথম আলোকে বলেন, ‘রাস্তার একপাশে গাড়ি চলছিল। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ ট্রাক এসে চাপা দেয়। আমরা ছিটকে পড়ি সড়কের ওপর। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাই। এরপর চার দিন হাসপাতালে থাকতে হয়। চিকিৎসা এখনো চলছে।’

১০ মাসে গেল ১ হাজার ২২৭ প্রাণ

চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিভাগে ১ হাজার ১২৬টি দুর্ঘটনায় ১ হাজার ২২৭ জনের প্রাণ গেছে। এর মধ্যে গত অক্টোবরে চট্টগ্রাম জেলায় ৩৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছে। দেশের একক জেলা হিসেবে ওই মাসে এটিই সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও মৃত্যু। গত রোববার রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল, বিভিন্ন ইলেকট্রনিক মিডিয়া এবং নিজস্ব তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে সংগঠনটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অক্টোবরে চট্টগ্রাম বিভাগে মোট ৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৮১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে জেলায় ৩৯ জন।

দুর্ঘটনার জন্য ১০টি কারণ উল্লেখ করেছে রোড সেফটি ফাউন্ডেশন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, বেপরোয়া গতি, চালকদের বেপরোয়া মানসিকতা, অদক্ষতা ও শারীরিক-মানসিক অসুস্থতা, মহাসড়কে স্বল্পগতির যানবাহন চলাচল, তরুণ-যুবকদের বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালানো, ট্রাফিক আইন না জানা ও না মানার প্রবণতা, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা।

দুর্ঘটনা প্রতিরোধে একগুচ্ছ সুপারিশ দিয়েছে সংগঠনটি। তারা বলছে, দুর্ঘটনা প্রতিরোধে চালকদের বেতন ও কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করতে হবে। অধিকাংশ দুর্ঘটনা ঘটছে অতিরিক্ত গতির কারণে। গতি নিয়ন্ত্রণে প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি বাড়াতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব মহাসড়কে বিভাজক বসাতে হবে।

জানতে চাইলে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, সড়কে কোনো শৃঙ্খলা নেই। ফিটনেসবিহীন যানবাহন ও অদক্ষ-অসুস্থ চালক একটানা কাজ করেন। কিন্তু এসব দেখার দায়িত্ব যেসব সরকারি প্রতিষ্ঠানের, তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না। এসব প্রতিষ্ঠানের কোনো জবাবদিহি নেই। ফলে দুর্ঘটনা রোধ করতে হলে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনা ও কাঠামোগত সংস্কার দরকার।