ধানবীজ উৎপাদনের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বিলুপ্তপ্রায় স্থানীয় জাতের ধানবীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার আবু হানিফা।
তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ার সময় আবু হানিফার বাবা মারা যান। অভাবের সংসারের ভার এসে পড়ে তাঁর কাঁধে। পড়ালেখার পাশাপাশি বাজারে কেরোসিন বিক্রি করে কোনোমতে চলে সংসার। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় দৈনিক ৮০ টাকা মজুরিতে একটি ধানবীজ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানে কাজ নেন। ধান লাগানো, নিড়ানি দেওয়া, পরিচর্যা ও ফসল তোলা—সবই করতেন। ২০১৭ সালে এসএসসি পাসের পর ভর্তি হন কৃষি ডিপ্লোমা কোর্সে। সেই কোর্স শেষে ২০২০ সালে চাকরি ছেড়ে নিজেই বীজ উৎপাদন শুরু করেন।
এখন বাণিজ্যিকভাবে বীজ উৎপাদন করেন ২৫ বছর বয়সী আবু হানিফা। পাশাপাশি হারানো ধানের এক সংগ্রহশালা গড়ে তুলেছেন। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা উপজেলার ঘোগা ইউনিয়নের পারুলীতলা গ্রামের এই তরুণ ইতিমধ্যে মাঠে ২৫ জাতের ধানবীজ উৎপাদন করছেন। উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের আবাদে যখন স্থানীয় জাতের বিভিন্ন ধান বিলুপ্তির পথে, তখন হারানো ধানবীজ সংরক্ষণ ও উৎপাদন করে রাসায়নিকমুক্ত চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন আবু হানিফা।
ধান গবেষকেরা বলছেন, হানিফার উদ্যোগ ও কার্যক্রম প্রশংসার দাবিদার। বিলুপ্ত স্থানীয় জাত নিয়ে এমন কার্যক্রম অন্যান্য এলাকায়ও করা উচিত। কৃষি বিভাগ বলছে, হানিফার উদ্ভাবন সম্প্রসারিত হলে ধান উৎপাদনে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি আরও অনেককে কৃষিতে আগ্রহী করে তুলবে।
হানিফা মনে করেন, কৃষকেরা বিলুপ্ত জাতের ধান চাষ করলে সার ও কীটনাশক কম লাগবে। এতে কৃষক ও দেশ—দুই-ই উপকৃত হবে।
সপ্তম শ্রেণি থেকে শুরু
আবু হানিফা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বীজ উৎপাদনপ্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হই। তখন মাঠে কাজ করার সময় আনকমন (অপরিচিত) অনেক ধানের জাত দেখতাম। তখন থেকেই বীজগুলো সংগ্রহ শুরু করি। পরে এলাকার প্রবীণ কৃষকদের থেকে আরও বিভিন্ন জাত সম্পর্কে জানতে পারি। সেগুলোও বিভিন্ন এলাকা থেকে সংরক্ষণ করি।’ তিনি জানান, কোম্পানির চাকরি ছেড়ে ২০২২ সালে প্রথমে বীজ ডিলার ও পরে সিড অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন। বাবার রেখে যাওয়া ৫২ শতক জমির সঙ্গে কৃষকদের থেকে কিছু জমি ইজারা নেন। বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করে বীজ উৎপাদন শুরু করেন। কোম্পানির চাহিদামতো বীজ উৎপাদনের পাশাপাশি বিলুপ্ত জাতের বীজ নিয়ে কাজ করেন। কয়েক দশক আগেও কীটনাশক ছাড়া জমিতে ফসল ফলাতেন কৃষকেরা। কিন্তু উচ্চ ফলনশীল জাতের ধানের কারণে কৃষককে এখন প্রতিনিয়ত মাঠে কীটনাশক ও সার দিতে হয়। এতে অনিরাপদ হয়ে উঠছে খাদ্য। নিরাপদ খাদ্য সরবরাহের ভাবনা থেকে তিনি বিলুপ্ত ধানবীজ সংরক্ষণ করছেন। মাঠে গবেষণা করে কৃষকদের দিচ্ছেন।
হানিফা মনে করেন, কৃষকেরা বিলুপ্ত জাতের ধান চাষ করলে সার ও কীটনাশক কম লাগবে। এতে কৃষক ও দেশ—দুই-ই উপকৃত হবে।
কাছে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির অদূরে ১৮ শতক জমিতে নানা জাতের ধানের বীজতলা ভাগ ভাগ করে তৈরি করেছেন। মাঠে আছে বেগুনি রঙের পাতার ধানগাছ, হাফছি, কাইশাবিন্নি, টেপি বোরো, খাইলী বোরো, বাশিরাজ, বিরুই, কালিজিরা, তুলসীমালা, ব্রাউন রাইস-১ ও ২, রেড রাইসের ছয়টি ধরন, উফশী জিরা, উফশী জাতের পাঁচটি ধরন ও রণজিত ধান।
হারানো যেসব বীজ নিয়ে কাজ
পারুলীতলা গ্রামে আবু হানিফার খেতের দিকে যেতে দূর থেকে চোখে পড়ে সবুজ মাঠের বুকে বেগুনি রঙের ধানগাছ দিয়ে লেখা, ‘নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করি’। কাছে গিয়ে দেখা গেল, বাড়ির অদূরে ১৮ শতক জমিতে নানা জাতের ধানের বীজতলা ভাগ ভাগ করে তৈরি করেছেন। মাঠে আছে বেগুনি রঙের পাতার ধানগাছ, হাফছি, কাইশাবিন্নি, টেপি বোরো, খাইলী বোরো, বাশিরাজ, বিরুই, কালিজিরা, তুলসীমালা, ব্রাউন রাইস-১ ও ২, রেড রাইসের ছয়টি ধরন, উফশী জিরা, উফশী জাতের পাঁচটি ধরন ও রণজিত ধান। এ ছাড়া রত্নমালা, গুটিস্বর্ণা, নাজিরশাইল, ছোট ইরি, ব্রি-১৬, ২৮, ২৯, ৮৮, ৮৯ ও ১০০ জাতের বীজও সংরক্ষণে আছে বলে জানালেন আবু হানিফা। যেগুলো আগামী বোরো মৌসুমে চাষ করতে চান। শুধু ধানবীজ নয়, নিজের বাড়ির আঙিনায় করেছেন সবজির বাগান। ভার্মি কমপোস্ট সার তৈরি করে জমিতে ফসল ফলান। অন্য কৃষকদের উৎসাহিত করেন এবং পরামর্শ দেন।
হানিফা জানান, তাঁর উৎপাদিত বীজের ক্রেতা বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি), বেসরকারি বীজ কোম্পানি ও সাধারণ কৃষক। পাশাপাশি হারানো জাতের বীজ উৎপাদন শুরু করেছেন গত বছর। ইতিমধ্যে ৩৫ জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করেছেন। ২৫ জাতের বীজ বর্তমানে মাঠে উৎপাদন করছেন। বিলুপ্ত বীজগুলো অল্প করে কিছু কৃষককে দিয়ে চাষে অভ্যস্ত করেন হানিফা।
ধানবীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণ
ছাত্র থাকার সময়ই ধানবীজ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত থাকায় আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরতে যেতেন হানিফা। সংগ্রহ করেছেন বিলুপ্ত ধানের বীজ। জামালপুরের মাদারগঞ্জে একটি গ্রামে ঘুরতে গিয়ে রাস্তার পাশে জিরা ধান দেখতে পান। এক কৃষক ভারত থেকে জিরা ধানের বীজ নিয়ে এসেছিলেন। গত আমন মৌসুমে সেই জিরা ধানের বীজ এনে নিজে সংরক্ষণ ও বিস্তারের কাজ শুরু করেছেন।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার একটি গ্রাম থেকে ‘টেপি বোরো’ জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করেছিলেন হানিফা। পরে কৃষকের কাছ থেকে বীজ নিয়ে আসেন। মুক্তাগাছা উপজেলার দাওগাঁও ইউনিয়নের ভোরশাইল গ্রামের এক কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন বাশিরাজ ধানের বীজ।
পুরোনো ধানের বীজ উৎপাদন করে লাভের মুখ দেখেননি হানিফা; বরং বিনা মূল্যে কৃষকদের দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, স্থানীয় বাজারে পুরোনো বীজের চাহিদা খুব কম। তবে হারানো ধানবীজ নিতে অনেকে অনলাইনে যোগাযোগ করছেন। পুরোনো ধানের জাতগুলো মাঠে ছড়ালে লাভের মুখ দেখবেন। বীজের গুণগত মান এ বছর দেখা শেষ হলে আগামী বছর বিক্রি শুরুর আশা করছেন তিনি।
ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার একটি গ্রাম থেকে ‘টেপি বোরো’ জাতের ধানবীজ সংগ্রহ করেছিলেন হানিফা। পরে কৃষকের কাছ থেকে বীজ নিয়ে আসেন। মুক্তাগাছা উপজেলার দাওগাঁও ইউনিয়নের ভোরশাইল গ্রামের এক কৃষকের কাছ থেকে সংগ্রহ করেন বাশিরাজ ধানের বীজ।
প্রবীণ কৃষকেরা কী বলছেন
মুক্তাগাছার কাশিমপুর ইউনিয়নের পালগাঁও গ্রামের কৃষক মুস্তাফিজুর রহমান সাড়ে ১৯ শতক জমিতে ধান চাষ করেছেন। এর মধ্যে হানিফার কাছ থেকে নিয়ে কাইশাবিন্নি জাতের ধান আবাদ করেছেন ১০ শতক জমিতে। তিনি বলেন, ‘ধানের চারাগুলো যখন বড় হতে লাগল, দেখলাম পাতা লাল হয়ে যাচ্ছে। পরে হানিফার পরামর্শে একদিন ভোরে জমিতে এক বস্তা ছাই ছিটিয়ে দিই, তাতেই জমি ভালো হয়ে যায়। এখন পর্যন্ত কোনো কীটনাশক দিতে হয়নি। যেভাবে ধানের ছড়া বেরোচ্ছে, আশা করি পাঁচ মণের বেশি ধান হবে, যদি দুর্যোগে নষ্ট না হয়।’
পারুলীতলা গ্রামের কৃষক বিল্লাল হোসেন মুন্সি (৬৫) ১৯৭২ সাল থেকে কৃষিকাজ করেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকে যেসব ধান চাষ করেছেন, সেগুলো এখন আর মাঠে নেই। সবাই উচ্চ ফলনশীল জাত খোঁজেন। নিজে বীজ সংরক্ষণ করেন না। মাঝেমধ্যে বাজারের বীজ খারাপ হলে ফসলহানি হয়। আগে ফলন কম হলেও কীটনাশক ব্যবহার বা ফসলহানির শঙ্কা ছিল কম।
মানুষ নির্দিষ্ট কিছু জাতের ধান চাষ করায় বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। স্থানীয় জাতগুলো নিয়ে হানিফা যে গবেষণা করছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। তবে ল্যাবে আরও গভীর গবেষণা করা দরকার।বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন
কৃষি বিভাগ ও বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
হানিফার উদ্যোগের মাধ্যমে স্থানীয় জাতগুলো ছড়িয়ে দিতে পারলে খাদ্য উৎপাদনে সহায়ক হবে বলে মনে করেন মুক্তাগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন। তিনি বলেন, একজন কৃষক ও উদ্যোক্তা হিসেবে নতুন জাত উদ্ভাবনে হানিফার উদ্যোগ সম্প্রসারিত হলে খাদ্য উৎপাদনে তা যেমন ভূমিকা রাখবে, তেমনি অনেক উদ্যোক্তা কৃষিতে আগ্রহী হবেন।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ প্রজনন ও কৌলিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মানুষ নির্দিষ্ট কিছু জাতের ধান চাষ করায় বৈচিত্র্য কমে যাচ্ছে। স্থানীয় জাতগুলো নিয়ে হানিফা যে গবেষণা করছেন, তা প্রশংসার দাবিদার। তবে ল্যাবে আরও গভীর গবেষণা করা দরকার।’ হারানো ধানবীজের বাজার সম্পর্কে তিনি বলেন, বিরুই নামে একটি ধানের জাত আছে। বাণিজ্যিকভাবে সব কৃষক না করলেও কিছু কৃষক চাষ করেন। ফলন কম হলেও পুষ্টিগুণ বেশি। উচ্চ মূল্যে বিক্রি হয়। সুতরাং বিলুপ্ত স্থানীয় জাত নিয়ে এমন কার্যক্রম অন্যান্য এলাকায়ও করা উচিত।