আবির মিয়ার (২১) বাড়ি নেত্রকোনার পূর্বধলা উপজেলার পাবই গ্রামে। নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান তিনি। ২০২১ সালে এসএসসি পাস করে স্থানীয় একটি কলেজে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হন। তবে পরিবারে অভাব–অনটনের কারণে পড়াশোনা আর এগোয়নি। এখন তিনি সিলেট শহরের ফুটপাতে কাপড় বেচেন।
ফুটপাতে কাপড় বিক্রি করে আবিরের উপার্জন ভালোই ছিল। স্বাভাবিক সময়ে গড়ে প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় হতো। এখন দেশের চলমান পরিস্থিতিতে তাঁর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। কারণ, গত এক সপ্তাহের সহিংসতার কারণে দুই দিনই তিনি বাসা থেকে বের হননি। অন্য দিনগুলোয় বেরোলেও আয় হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা। এতে নিজের খরচ চালাতেই হিমশিম খাচ্ছেন আবির।
সিলেট নগরের মদিনা মার্কেট এলাকায় গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া ১১টার দিকে আবিরের সঙ্গে কথা হয়। কারফিউর সময় এত রাতেও ব্যবসা করছেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কারফিউ থাকায় মানুষজন বাইর হইতাছে কম। বেচাকেনা অয় না বললেই চলে। পুঁজি সব ব্যবসাত ঢুকাইছি। এখন মাল (কাপড়) কিনার মানুষ কম। আগের মতো আয় নাই, বড় কষ্টে আছি! তাই কারফিউ থাকলেও দুই-একটা কাপড় বেচার লাগি বাইরে আছি। গত দুই ঘণ্টায় একটা কাপড়ও বেচতাম পারছি না।’
সিলেট নগরের শাহী ঈদগাহ এলাকায় একটি বাসায় দুলাভাই ও বোনের ছেলের সঙ্গে থাকেন আবির। তাঁদের বাসাভাড়া সাড়ে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া প্রতি মাসে জনপ্রতি খাবার বাবদ গড়ে খরচ পড়ে তিন হাজার টাকা। এ ছাড়া বিদ্যুৎ ও গ্যাসের বিল বাবদ আরও দেড় থেকে দুই হাজার টাকা খরচ হয়। এর বাইরে হাতখরচ তো আছেই। এরপর আয় থেকে একটা অংশ গ্রামের বাড়িতে থাকা পরিবারের কাছে পাঠান।
আবির মিয়া জানান, এক সপ্তাহ ধরে আয় কমে যাওয়ায় তিনি বিপাকে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতি কবে পুরোপুরি দূর হবে, তা–ও অনুমান করতে পারছেন না। এই মাসে নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে টাকা পাঠাতে পারবেন কি না, এমন দুশ্চিন্তায় আছেন। বাড়িতে মা, বাবা ও ভাই-বোনেরা থাকেন। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে আবির তৃতীয়।
মদিনা মার্কেট এলাকায় সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের যে অংশে আবির ভ্যানে করে গেঞ্জি, শার্ট, প্যান্ট আর পাঞ্জাবি বিক্রি করছিলেন, তার ঠিক ১০০ গজ দূরে সবজি বিক্রি করছিলেন এক সবজি বিক্রেতা। কাছে গিয়ে এ প্রতিবেদক নিজের পরিচয় দিয়ে আলাপ শুরু করলে ওই সবজি বিক্রেতা জানান, তাঁর নাম অনন্ত দাশ (৪০)।
নগরের উত্তর পাঠানটুলা এলাকায় পাঁচ হাজার টাকা ভাড়ায় একটা বাসায় থাকেন। তাঁর মূল বাড়ি সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার উপজেলায়। ২০ থেকে ২২ বছর ধরে এ শহরে আছেন।
অনন্ত জানান, প্রতিদিন গড়ে তাঁর চার থেকে পাঁচ হাজার টাকার সবজি বিক্রি হতো। এখন মানুষজনের চলাচল কমে গেছে। তাঁর আয়ও তাই কমেছে। এখন গড়ে এক থেকে দেড় হাজার টাকার সবজি বিক্রি হয়। সবজি কেনাসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় মিটিয়ে লাভ খুব একটা থাকে না। সহিংস পরিস্থিতির কারণে গত কয়েক দিন ব্যবসাও করতে পারেননি। আয় কমে যাওয়ায় ভোগান্তিতে পড়েছেন। এ অবস্থায় বয়স্ক মা, স্ত্রী, নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া ছেলে, সপ্তম শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়েসহ পাঁচ সদস্যের পরিবারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন অনন্ত।
আয় কমে যাওয়ায় চলতি মাসে বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ বিলসহ পরিবারের সদস্যদের অন্যান্য চাহিদা মেটাতে বেগ পেতে হচ্ছে বলে জানান অনন্ত দাশ। তিনি বলেন, ‘এখন বেচাবিক্রি অয় না। ডরাইয়া অনেকে (সবজি ব্যবসায়ী) মাল (সবজি) আনে না। কারণ, বিক্রি না অইলে পচি যাইব, অর্ধেক ফালাইন লাগব। আমি আইজ (বৃহস্পতিবার) মাল আনছিলাম, চাইর ভাগের এক ভাগও বেচতাম পারছি না, ধরা খাইছি। পুরাই লস।’