জুন, জুলাই ও আগস্ট—এই তিন মাস সুন্দরবনে বন্য প্রাণী ও মাছের প্রজনন মৌসুম। এই সময় বনের নদী-খালে মাছ শিকার ও বনের ভেতর পর্যটক প্রবেশে বন বিভাগের নিষেধাজ্ঞা চলে। এ কারণে সুন্দরবনে জেলে ও পর্যটকের কোলাহল নেই, নেই নৌযানের শব্দ। নিজেদের আবাসে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পাখপাখালি আর বন্য প্রাণীর দল। বনের চরাঞ্চলেও দেখা মিলছে তাদের। গাছের ডালে ডালে পাখপাখালির কিচিরমিচির-ডাকাডাকি ও নদী-খালে বন্য প্রাণীর অবাধ সাঁতার। নিজেদের আবাসে নিজেদের মতো থাকতে পারার উচ্ছ্বলতা দেখা গেছে এদের মাঝে।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে সুন্দরবনের নীলকমল অভয়ারণ্য কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, বনের প্রাণিকুল নীরব পরিবেশ পছন্দ করে। পর্যটক ও নৌযানের শব্দ না আসায় নীরব পরিবেশে সুন্দরবনের প্রাণীরা নিজেদের মতো বেড়ে উঠছে। এখন সুন্দরবনের মধ্যে নদী-খালে চিংড়ি, দাতিনা, পারশেসহ বিভিন্ন প্রজাতির মাছের ঝাঁক দেখা যাচ্ছে। পাখির কলরব স্পষ্ট শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। বন্য প্রাণীরাও নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সুন্দরবনের কচিখালী অভয়ারণ্য অফিসের বনরক্ষী মোস্তাক আহমেদ বলেন, ‘৮ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমাদের অফিসের বাইরে একটি বাঘ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ বাঘটি দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম। ভয়ে ভয়ে মুঠোফোন দিয়ে বাঘের ভিডিও করতে থাকি। কিছুক্ষণ পরে বাঘটি বনের দিকে চলে যায়।’
বন বিভাগ সূত্র জানায়, বঙ্গোপসাগরের উপকূলবর্তী ৬ হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ বন প্রায় ৪৫০টি নদী-খালবেষ্টিত। বনে সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়াসহ ৩৩৪ প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। আছে বিখ্যাত বেঙ্গল টাইগার, চিত্রা হরিণ, কুমির, বানরসহ বিভিন্ন ধরনের প্রাণী। ২৭০ প্রজাতির পাখি, ৪২ প্রজাতির স্তন্যপায়ী, ৩৫ প্রজাতির সরীসৃপ, ৮ উভচর প্রজাতির আবাসস্থল সুন্দরবন এবং নদী-খালে আছে কাঁকড়া, শামুকসহ ১২০ প্রজাতির মাছ।
সুন্দরবনের বানিয়াখালী ফরেস্ট স্টেশনের কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ বলেন, যেসব প্রাণীর অহরহ দেখা মিলত না, এখন সুন্দরবনে সেসব প্রাণীর ছোটাছুটি আর কোলাহল চোখে পড়ছে। বনের চরাঞ্চলে নির্ভয়ে বিচরণ করছে হরিণ, বানর, বন মোরগ, শূকরসহ নানা প্রজাতির বন্য প্রাণী। বিষধর সাপ, কাঁকড়া ও হরেকরকম পাখির আনাগোনা বেড়েছে। নদীর মোহনায় দেখা মিলছে কুমির ও শুশুক। পর্যটক ও জেলে শূন্য থাকায় প্রাকৃতিক বন নিজের মতো গুছিয়ে নিতে পেরেছে।
বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর সুন্দরবনে সম্পদ আহরণের জন্য প্রায় ১২ হাজার নৌকা ও ট্রলারকে বনে প্রবেশের অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। এসব নৌযানের মাধ্যমে প্রতিবছর এক থেকে দেড় লাখ জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল সুন্দরবনের সম্পদ আহরণ করেন। এ ছাড়া সুন্দরবনের সাতটি ইকো–ট্যুরিজম কেন্দ্রে প্রতিবছর আড়াই লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করেন।
সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, সুন্দরবনের সুরক্ষায় এই বনের ওপর নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীর বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য রাষ্ট্রীয় পদক্ষেপ দরকার। সুন্দরবনে প্রবেশাধিকার আরও সংরক্ষিত হওয়া দরকার। সুন্দরবন থেকে রাজস্ব আসছে—এই চিন্তা বাদ দিয়ে সুন্দরবনকে বিরক্ত না করে বনটাকে বনের মতো থাকতে দিতে হবে।
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দে বলেন, তিন মাসের বন্ধ মৌসুমের নীরবতার কারণে আগে যেসব প্রাণী তেমন দেখা যেত না, সেগুলোর দেখা মিলছে। আগে যেসব জায়গায় বাঘের উপস্থিতি ছিল না, এখন সেসব জায়গায় বাঘের আনাগোনা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া সুন্দরবনের ৫২ শতাংশ স্থান অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কোনো জেলে, বাওয়ালি বা বনজীবী প্রবেশ করতে পারেন না। ভবিষ্যতে আরও এলাকা অভয়ারণ্য ঘোষণা করা হবে।