বাটিতে সিরায় ভেজা গরম রসগোল্লা। টাটকা ছানার ননির ঘ্রাণ উঠছে সেখান থেকে। চামচে তুলে মুখে দিতেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে। তুলতুলে নরম আর ঘন দুধের স্বাদ। একটা, দুটো খেলে কি মন ভরে? নিজের অজান্তেই হয়তো আট–দশটি খেয়ে ফেলবেন। চট্টগ্রামের পটিয়ার কমলমুন্সির হাটের গৌরাঙ্গর রসগোল্লার স্বাদটাই এমন। লোকে বলে, নেশা ধরানো রসগোল্লা। এক বসায় অনেকে আধা কেজিও খেয়ে ফেলেন।
পুরোনো বেড়ার সঙ্গে রং লাগানো পিচবোর্ড ও টিনশেডের দোকান। সামনে ছোট কক্ষে তিনটি নড়বড়ে টেবিল আর কিছু চেয়ার সাজানো। পেছনে কারখানা। তবে দর্শনে যতই জীর্ণ হোক না কেন মোহনীয় রসগোল্লার ঘ্রাণ সব ছাপিয়ে মন কেড়ে নেয়। গৌরাঙ্গের মিষ্টির দোকানের সামনে তাই সব সময় ভিড় লেগেই থাকে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কের পটিয়া উপজেলার সদর থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে কমলমুন্সির হাট। হাটে নেমে কাঁচা বাজারের সরু গলি দিয়ে কিছু দূর গেলেই গৌরাঙ্গের দোকানের দেখা মেলে। দোকানের আলমারিতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে টাটকা জিলাপি ও নিমকি। বড় কয়েকটি গামলাতে রসের ভেতর ভাসছে রসগোল্লা। কেবল রসগোল্লাই নয়, রসমলাই, রসমঞ্জরি, জিলাপিসহ নানান রকমের মিষ্টি দেখা গেল দোখানে। তবে এখানকার রসগোল্লার খ্যাতিই বেশি।
গত বুধবার সরেজমিনে গৌরাঙ্গ মিষ্টি বিতানে গিয়ে দেখা গেল, কয়েকজন ক্রেতা বসে মিষ্টি খাচ্ছেন। তাদের মধ্যে কচুয়াই ইউনিয়নের শেখ মোহাম্মদ পাড়া গ্রামের শওকত আলী বলেন, ‘গরুর খাঁটি দুধের ছানা থেকেই এই দোকানের রসগোল্লা তৈরি হয়। আমরা বন্ধুবান্ধব মিলে প্রায় দিনই রসগোল্লা খেতে এখানে চলে আসি। স্বাদ অতুলনীয়। তুলতুলে মিষ্টি একটা-দুইটা নয়, কয়েক হালি না খেলে তৃপ্তি মেটে না। এক কামড়ে মুখে পুরো রসগোল্লা গলে যায়। এখানের নিমকির স্বাদও আলাদা।’
পটিয়ার কচুয়াই ইউনিয়নের চক্রশালা গ্রামের গৌরাঙ্গ দাশের হাত ধরে এই দোকানের রসগোল্লার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যবসা চালাচ্ছেন তার একমাত্র ছেলে সুমন দাশ। দোকানের ক্যাশে বসে সুমন দাস শোনালেন তাঁদের গল্প। তিনি বলেন, এক সময় তাঁর ঠাকুর দাদা অর্থাৎ গৌরাঙ্গ দাশের বাবা সারদা দাশ চট্টগ্রামের কোরবানীগঞ্জে একটি মিষ্টির দোকানে চাকরি করতেন। সেখানে তিনি রসগোল্লার কারিগর হিসেবে দক্ষতা অর্জন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তিনি পটিয়ায় গ্রামের বাড়ি চক্রশালায় চলে আসেন। ১৯৭৩ সালে কমলমুন্সির হাটের এক বেকারি মালিকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে সারদা দাস শুরু করেন ছোট্ট একটা মিষ্টির দোকান। বড় ছেলে গৌরাঙ্গ ছোটবেলা থেকে বাবার দোকানে রসগোল্লা বানানোর কাজ করতেন। এক সময় গৌরাঙ্গ দাস হয়ে ওঠেন দক্ষ কারিগর। ১৯৮৩ সালে সারদা দাশ মারা যাওয়ার পর গৌরাঙ্গ দাস ব্যবসার হাল ধরেন। তাঁর রসগোল্লার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও। এই দোকানে অনেক তারকাও আসেন রসগোল্লা খেতে। প্রয়াত শিল্পী সুবীর নন্দী, আইয়ুব বাচ্চুও এই দোকানের রসগোল্লার স্বাদ নিয়েছেন বলে জানান সুমন দাশ।
বর্তমানে গৌরাঙ্গের দোকানে কারিগরসহ ১৬ জন কর্মচারী কাজ করেন। সুমন দাস বলেন, ‘১১ বছর বয়স থেকে দোকানে বাবাকে সহযোগিতা করতাম। এই দোকানে আমার রসগোল্লা বানানোর হাতেখড়ি। ২০১২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর আমি ব্যবসার হাল ধরি। তখন আমি দোকানটি নাম দিই গৌরাঙ্গ মিষ্টি বিতান। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে থেকে ৪০-৫০ কেজি করে দুধ লাগে। তবে পয়লা বৈশাখ, ঈদ, দুর্গা পূজাসহ বিভিন্ন উৎসবে প্রায় ৪০০ থেকে ৬০০ কেজির বেশি দুধের প্রয়োজন হয়।’
গৌরাঙ্গের মিষ্টি এখন এলাকার ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এলাকার বাইরে থেকেও লোকজন রসগোল্লা কিনতে আসেন। পটিয়া ছাড়াও ঢাকা কিংবা কক্সবাজার জেলা থেকেও অর্ডার আসে। অনেক সময় অগ্রিম অর্ডার দিয়েও পেতে কষ্ট হয় বলে জানান ক্রেতারা।
চট্টগ্রামের প্রখ্যাত আলোক চিত্র শিল্পী শোয়েব ফারুকী বলেন, ‘পটিয়া চক্রশালা কৃষি উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়ার সময় এই দোকানের রসগোল্লার সুনাম শুনে এসেছি। তখন থেকে এ দোকানে আসি। গৌরাঙ্গ বাবুর ছেলে সুমন আগের সেই ঐতিহ্য এখনো ধরে রেখেছেন। দক্ষিণ চট্টগ্রাম বা কক্সবাজার গেলেই মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে এ দোকান থেকে বেশি করে রসগোল্লা নিয়ে নিই।’
প্রায় চার কিলোমিটার দূর থেকে উপজেলার দক্ষিণ ভূর্ষি ইউনিয়নের অমল কুমার দে নামের একজন সাত কেজি রসগোল্লা কিনছিলেন। পটিয়া সদরে অনেক মিষ্টির দোকান থাকতেও এতে দূরে কেন মিষ্টি নিতে এসেছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এদের রসগোল্লা খুবই সুস্বাদু। ছেলের বিয়ে। রাঙামাটিতে বেয়াই বাড়িতে বউ আনতে যাব রসগোল্লা নিয়ে।’
দুধ থেকে ছানা কেটে সেই ছানা ও চিনি দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন সুমন দাস। সনাতন পদ্ধতিতে হাতে মিষ্টি তৈরি করা হয়। দুধের ঘনত্ব যত বেশি, মিষ্টিও তত সুস্বাদু। ৬ কেজি দুধ থেকে এক কেজি ছানা এবং এক কেজি ছানা থেকে সাড়ে তিন কেজি মিষ্টি তৈরি হয়। কোনো ধরনের রং, রাসায়নিক বা ক্ষতিকারক কিছু ব্যবহার করা হয় না। ছানা তৈরিতে ব্যবহার হয় লেবুর রস। প্রতি কেজি রসগোল্লা ২৮০ টাকা, রসমালাই প্রতি কেজি ৩২০ টাকা, টক দই ১৩০ টাকা, মিষ্টি দই ২৬০ টাকা, রসমঞ্জরি ৪০০ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ থেকে ১৮০ কেজি পর্যন্ত রসগোল্লা বিক্রি হয়। তবে প্রতি বৃহস্পতিবার, শুক্রবার ও শনিবারে দোকানটিতে ভিড় বাড়ে। বর্তমানে দুধ, চিনিসহ নানা উপকরণে দাম বৃদ্ধি পাওয়াতে দোকানের ঐতিহ্য ধরে রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বলে জানান সুমন।