ছেলে মাহবুবের সঙ্গে বাবা মশিউর রহমান ও মা হালিমা বেগম। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তাঁরা। গত শনিবার দুপুরে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় তোলা
ছেলে মাহবুবের সঙ্গে বাবা মশিউর রহমান ও মা হালিমা বেগম। উন্নত চিকিৎসার জন্য সরকারের সহযোগিতা চেয়েছেন তাঁরা। গত শনিবার দুপুরে শহরের মিশনপাড়া এলাকায় তোলা

ভারত-থাইল্যান্ডে চিকিৎসা নিয়েও দৃষ্টিহীন মাহবুব, চোখের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারেন না

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছররা গুলিতে দুই চোখের আলো হারিয়েছেন মাহবুব আলম (২৯)। গত ১৮ জুলাই চোখে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর দেশে-বিদেশে চিকিৎসা নিয়েছেন তিনি। আঘাতে তাঁর চোখের নার্ভ ছিঁড়ে। সেই সঙ্গে বাঁ চোখের পর্দাও ফেটে গেছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আপাতত আর দেখতে পাবেন না তিনি। জার্মানি কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে চিকিৎসা সম্ভব। কিন্তু আর্থিক সংগতি না থাকায় সেদিকে আর পা বাড়ায়নি পরিবার।

২৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে নারায়ণগঞ্জ শহরের মিশনপাড়া এলাকার ভাড়া বাড়িতে মাহবুব ও তাঁর পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। মা হালিমা বেগমের হাত ধরে গুটি গুটি পায়ে বসার ঘরে আসেন মাহবুব। এটুকু পথ আসতে গিয়ে রেফ্রিজারেটর ও ডাইনিং টেবিলের সঙ্গে ধাক্কা খান তিনি।

মাহবুব নারায়ণগঞ্জ সরকারি তোলারাম কলেজ থেকে চলতি বছর স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। তাঁর বাবা মশিউর রহমান সুতার ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলায়, তবে তাঁদের নারায়ণগঞ্জ শহরে বসবাস। মশিউর ও হালিমা দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে মাহবুব দ্বিতীয়। তাঁদের বড় মেয়ে কিডনি জটিলতায় গত বছরের জুলাইয়ে মারা যান। বর্তমানে মাহবুব ও তাঁর দুই মেয়ে আছে। আট মাস আগে বিয়ে করেছেন মাহবুব। আর এই সময়েই তাঁর চোখের আলো নিভে গেছে।

১৮ জুলাই বেলা ১১টা থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে নগরের চাষাঢ়া শহীদ মিনার ও গোল চত্বরে অবস্থান নেন শিক্ষার্থীরা। পুলিশ তাঁদের ছত্রভঙ্গ করতে ধাওয়া দেয় ও গুলি ছোড়ে। এ সময় পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে ভাঙচুরের পাশাপাশি আগুন দেওয়া হয়। এ সময় পুলিশ আরও মারমুখী হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে বলে জানান জেলার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ফারাহানা মানিক (মুনা)। তিনি বলেন, ওই দিন পুলিশের গুলিতে দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন মাহবুব।

ছেলের চোখে ঔষধ দিয়ে দিচ্ছেন মা হালিমা বেগম। গত শনিবার দুপুরে শহরের মিশনপাড়া এলাকায়

সেদিনের ঘটনার বর্ণনায় মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে অষ্টম, নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। পুলিশ এলোপাতাড়ি গুলি ছুড়তে থাকলে শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে তাঁদের সেইফ জোনে (নিরাপদ জায়গায়) নিতে মাধবী প্লাজার গলির ভেতরে ঢুকে পড়ি। কিছুক্ষণ পর পুলিশ আছে কি না, দেখতে উঁকি দিলে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের ছররা গুলি এসে বাঁ চোখ ও মাথায় লাগে। এখন চোখের যন্ত্রণায় রাতে ঘুমানো যায় না।’

আহত হওয়ার পর মাহবুবকে রাজধানীর চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে নিয়ে যাওয়া হয় বলে জানান তাঁর মা হালিমা বেগম। তিনি জানান, ওই সময় হাসপাতালে পুলিশের গুলিতে আহত ব্যক্তিদের ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল না। ছেলের চোখ বাঁচাতে পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ভারতের চেন্নাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আবার তাঁর চিকিৎসা চলে থাইল্যান্ডে। ১৭ দিন সেখানে অবস্থানের পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে আসেন তাঁরা। ওই সময় চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, মাহবুবের চোখের আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

ছেলের চোখ বাঁচাতে পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ভারতের চেন্নাইয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে আবার তাঁর চিকিৎসা চলে থাইল্যান্ডে। ১৭ দিন সেখানে অবস্থানের পর গত ১৫ সেপ্টেম্বর দেশে ফিরে আসেন তাঁরা। ওই সময় চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, মাহবুবের চোখের আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।

হালিমা আক্ষেপ করে বললেন, সরকার যেভাবে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের পাখির মতো গুলি করে হত্যা করেছে, এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি মাহবুব। ছাত্রদের সঙ্গে সেও আন্দোলনে চলে যায়। আন্দোলনে দ্বিতীয়বার দেশ স্বাধীন হলেও আনন্দটুকু নিজের চোখে দেখতে পারল না। বাবা-মায়ের কাছে এর চেয়ে বড় কষ্ট আর কী হতে পারে?

মাহবুবের বাবা মশিউর রহমানও বেশ অসুস্থ। তিনি ও তাঁর ছেলে মাহবুবের চিকিৎসায় পুরো পরিবার এখন অন্ধকারে ডুবে আছে বলে হালিমা। তিনি বলেন, সন্তান ভবিষ্যতে মা-বাবাকে পথ দেখিয়ে চলাবেন, কিন্তু সেই সন্তানকেই মা-বাবার হাত ধরে চলতে হচ্ছে, এটা বলতে গিয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন হালিমা।

মাহবুবের বাঁ চোখে গুলি লেগে নার্ভ ছিঁড়ে গেছে এবং চোখের পর্দা ফেটে গেছে। গুলি হাড় ভেদ করে ব্রেনের ভেতরে চলে গেছে। এ কারণে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে গুলিগুলো যেখানে আছে, ওটা ক্ষতি করবে না। তবু আমরা আশাবাদী, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
রেটিনা গ্লুকোমা সেন্টারের চিকিৎসক অধ্যাপক মো. আল হায়াৎ

ইতিমধ্যে মাহবুবের চিকিৎসায় ১০ লাখ টাকার বেশি খরচ করা হলেও চোখের আলো ফেরেনি বলে জানান তাঁর বাবা মশিউর রহমান। তিনি বলেন, চিকিৎসকেরা আশ্বাস দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র বা জার্মানিতে নিতে পারলে মাহবুবের চোখের আলো ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য নেই। সরকার সহযোগিতা করলে বিদেশে উন্নত চিকিৎসায় আমার ছেলের চোখের আলো ফিরে পেতে পারে। না হলে বাকি জীবন অন্ধত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াতে হবে।

এ বিষয়ে জানতে রাজধানীর রেটিনা গ্লুকোমা সেন্টারের চিকিৎসক অধ্যাপক মো. আল হায়াৎ পাঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘মাহবুবের বাঁ চোখে গুলি লেগে নার্ভ ছিঁড়ে গেছে এবং চোখের পর্দা ফেটে গেছে। গুলি হাড় ভেদ করে ব্রেনের ভেতরে চলে গেছে। এ কারণে দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তবে গুলিগুলো যেখানে আছে, ওটা ক্ষতি করবে না। তবু আমরা আশাবাদী, চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’