৩৮ বছর বয়সী দুলাল মাহমুদ ছিলেন দরিদ্র পরিবারের সন্তান। দরিদ্রতার সঙ্গে সংগ্রাম করে স্নাতকোত্তর পাস করেছিলেন। ঢাকায় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকে সহকারী ব্যবস্থাপক পদে চাকরি করতেন। দু্ই শিশুসন্তান, স্ত্রী ও মা–বাবাকে নিয়ে সুখেই কাটছিল জীবন। পরিবারের অন্য সদস্যদের প্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন ছিল; কিন্তু ১৮ জুলাই রাজধানীর আজিমপুরে কোটা আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষের মধে৵ পড়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন মৃত্যু হয় তাঁর।
দুলাল শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলার বড়কান্দি ইউনিয়নের চরখাগুটিয়া গ্রামের সিদ্দিক খালাসি ও জুলেখা বেগম দম্পতির ছেলে। দুলালের এমন মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না পরিবার। দুই শিশুসন্তানকে এখন কে দেখবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে—এমন দুশ্চিন্তায় দুলালের বৃদ্ধ মা–বাবা।
গ্রামবাসী ও দুলালের স্বজনেরা জানান, িসদ্দিক খালাসি ও জুলেখা বিবির সাত সন্তান। দুলাল তাদের একজন। অনেক বছর ধরে সিদ্দিক খালাসি অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তাই পরিবারের অন্য ভাই-বোনদের পড়ালেখা করা হয়নি। সবাইকেই কিশোর বয়সে কৃষিকাজে মনোযোগ দিতে হয়েছে। দুলাল কৃষিকাজের পাশাপাশি পড়ালেখা চালিয়ে গেছেন।
১৮ জুলাই ব্যাংকের কাজ শেষে কারওয়ানবাজার থেকে সন্ধ্যায় বাসার উদ্দেশে রওনা হন দুলাল। আজিমপুর কলোনির কাছে এলে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।
দুলালের সাত বছরের আদিয়াত ও সাড়ে তিন বছর বয়সের আরিশা নামের দুটি সন্তান রয়েছে। ঢাকার আজিমপুরে স্ত্রী, দুই সন্তান ও মা–বাবাকে নিয়ে বসবাস করতেন তিনি।
১৮ জুলাই ব্যাংকের কাজ শেষে কারওয়ানবাজার থেকে সন্ধ্যায় বাসার উদ্দেশে রওনা হন দুলাল। আজিমপুর কলোনির কাছে এলে দুই পক্ষের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে যান। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরের দিন ১৯ জুলাই সকাল ছয়টার দিকে তাঁর মৃত্যু হয়।
শরীয়তপুর জেলা শহর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে কাজীরহাট-মঙ্গলমাঝি ও সাত্তার মাদবরের ঘাট সড়কের পাশে চরখাগুটিয়া গ্রাম। পাকা সড়ক থেকে ৩০০ মিটার পূর্ব দিকে একটি খালের পাড়ে দুলালদের বাড়ি। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সড়ক থেকে নৌকায় চড়ে তাঁদের বাড়িতে যেতে হয়। শনিবার দুপুরে গিয়ে দেখা যায়, পৈতৃক বাড়ির পাশে আলাদা বাড়ি করার জন্য একটুকরা জমি কিনেছিলেন দুলাল। ওই জমির এক পাশে তাঁকে কবর দেওয়া হয়েছে। বাড়ির পুরোনো ঘরের একটি কক্ষে অসুস্থ বাবা সিদ্দিক খালাসি বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁর পাশে বসে জুলেখা বিবি তসবি হাতে ছেলের জন্য দোয়া করছেন আর চোখের পানি মুছছেন।
সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে অঝোর ধারায় কান্না শুরু করলেন জুলেখা বিবি। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘কারও সাতে-পাঁচে আমরা নেই। সাত সন্তানের মধ্যে দুলালই শিক্ষিত। সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল। কেন ছেলেকে অকালে প্রাণ হারাতে হলো? ওর হত্যাকারীদের বিচার কার কাছে চাইব?’
পাকা সড়ক থেকে ৩০০ মিটার পূর্ব দিকে একটি খালের পাড়ে দুলালদের বাড়ি। বর্ষা মৌসুম হওয়ায় সড়ক থেকে নৌকায় চড়ে তাঁদের বাড়িতে যেতে হয়
১৯ জুলাই শুক্রবার সকালে দুলালের মৃত্যু হয়। ২১ জুলাই রোববার তাঁর লাশ গ্রামে এনে দাফন করা হয়। দুলালের লাশের সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও দুই শিশুসন্তান গ্রামে আসেন। কয়েক দিন গ্রামে থাকার পর কিছু প্রয়োজনে তাঁর স্ত্রী শিশুসন্তানদের নিয়ে ঢাকার বাসায় ফিরে যান।
দুলালের সন্তানেরা কেমন আছে জানতে তাঁর স্ত্রী ফারজানা আক্তারের মুঠোফোনে কল দিলে সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। তাঁদের সুখের সংসারে এমন পরিস্থিতি কেন হলো? তাঁর সন্তানদের ভবিষ্যৎ ও নিরাপত্তা কে দেবে—এমন প্রশ্ন করে তিনি আবার কাঁদতে থাকেন।
কারও সাতে-পাঁচে আমরা নেই। সাত সন্তানের মধ্যে দুলালই শিক্ষিত। সে সংসারের দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল। কেন ছেলেকে অকালে প্রাণ হারাতে হলো? ওর হত্যাকারীদের বিচার কার কাছে চাইব?জুলেখা বিবি
জাজিরার পূর্ব নাওডোবা পাবলিক উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ইদ্রিস আলী প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুলাল খুব মেধাবী ও ভদ্র ছেলে ছিল। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে কখনো চালিয়েছে ভ্যান, আবার কখনো তাকে কৃষিকাজ করতে হয়েছে। তার এমন মৃত্যু আমরা মানতে পারছি না। ওর মৃত্যুতে পরিবারটি অসহায় হয়ে পড়েছে।’