খালের পানির ওপর ভরসা করে কয়েক শ একর জমিতে বোরো ধান, তরমুজ, আলু, শর্ষে, সূর্যমুখীসহ বিভিন্ন জাতের সবজি লাগানো হয়। খালের পানি প্রথম দিকে মিষ্টি থাকলেও, ইজারাদাররা নানা কৌশলে লোনাপানি উঠিয়ে নষ্ট করেন কৃষকের ফসল। সেই সঙ্গে ধ্বংস করে দেন দরিদ্র কৃষকের পরিশ্রমে গড়া স্বপ্ন।
কথাগুলো বলছিলেন খুলনার কয়রা উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক ইসহাক আলী সরদার। আমন চাষের পর তিনি তাঁর নিজের সাড়ে তিন বিঘা জমিতে সবজি আবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তাঁর জমির পাশে তেরআউলিয়া নামের খালটিতে মিঠাপানি ছিল। বর্তমানে সেখানে নোনাপানি উঠিয়ে মাছ চাষ করছেন খালের ইজারাদার। যে কারণে খালের আশপাশে প্রায় ২০০ একর জমিতে চাষাবাদ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
শুধু ওই খাল নয়, কয়রা উপজেলার সাতটি ইউনিয়নে এমন শতাধিক বদ্ধ খাল মাছচাষিদের কাছে প্রতি তিন বছর পরপর ইজারা দেওয়া হয়। ইজারার চুক্তি অনুযায়ী এসব খালে নোনাপানি ওঠানো নিষেধ। কিন্তু ইজারাগ্রহীতারা গোপনে স্লুইসগেট গেটের কপাট খুলে নোনাপানি তোলেন। ফলে ওই সব খালের পানির ভরসায় যেসব কৃষক শুষ্ক মৌসুমে চাষাবাদের চেষ্টা করেন, তাঁরা প্রতিবছর লোকসান গুনছেন। দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদের স্বার্থে এসব খাল ইজারা না দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন স্থানীয় কৃষকেরা।
গত শনিবার কয়রার তেরআউলিয়া খাল এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, খালটি মসজিদকুড় গ্রাম থেকে শুরু হয়ে চন্ডিপুর, দশবাড়িয়া, কিনুকাঠী, খেপনা গ্রামের মধ্য দিয়ে ঘোষখালী খাল হয়ে শিবসা নদীতে গিয়ে মিশেছে। চন্ডিপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে খালের পাড়ের জমিতে কুমড়া, শসা, আলুসহ নানা সবজির চাষাবাদ হয়েছে। দূরের পুকুর থেকে পাইপের মাধ্যমে পানি এনে সবজি খেতে ছিটাচ্ছিলেন আমেনা বেগম। তিনি বলেন, খেতের পাশেই খালে পানি, কিন্তু সে পানিতে চাষাবাদ হয় না। খালের মধ্যে তুলে আনা নদীর পানি এতটাই নোনা যে, ওই পানির ছিটেফোঁটা গাছে লাগলেই গাছ মারা যায়।
চন্ডিপুর গ্রামের আইয়ুব আলী গাজী বলেন, শুধু যদি তেরআউলিয়া খালে নোনাপানি ওঠা বন্ধ হয়, তাহলে অন্তত দুই হাজার বিঘা জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। চন্ডিপুর গ্রামের ভেতরের সড়ক ধরে কিছু দূর এগোলেই প্রায় আড়াই কিলোমিটার দীর্ঘ পুঁটিমারার খাল। তার কিছুটা দূরে আমাদী গ্রামের মধ্য দিয়ে খিরোল গ্রামের দিকে চলে গেছে প্রায় তিন কিলোমিটার কুমিরমারার খাল। দুটি খালের পানিও লবণাক্ত। খালের পার্শ্ববর্তী পাটুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা দুলাল চন্দ্র সরকার বলেন, খালে নোনাপানি, তাই দূর থেকে সেচের পানি এনে চাষাবাদ করতে হচ্ছে। এক বিঘা জমিতে একবার পানি দিতে ৪০০ টাকা করে সেচপাম্পের মালিককে দিতে হয়।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, এই এলাকার বিলের মধ্যে ছোট-বড় অনেক খাল রয়েছে। প্রায় সব কটিই তেরআউলিয়া খালের শাখা। এসব খাল বর্ষা মৌসুমে মিষ্টি পানিতে ভরা থাকে। শুষ্ক মৌসুমে খালের পানি সেচ কাজে ব্যবহার করা গেলে স্থানীয় চাষিরা লাভবান হতেন। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এসে ইজারাদাররা গোপনে খালে নোনাপানি তোলেন। ফলে পানি আর সেচকাজে ব্যবহার সম্ভব হয় না।
কয়রা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, এ ধরনের সমস্যা নিয়ে অনেক কৃষক তাঁদের কাছে অভিযোগ জানাতে আসেন। তাঁরা কৃষকদের বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
কয়রা উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ৩৯টি খাল নিয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, খালগুলোয় নোনা পানির অনুপ্রবেশ বন্ধ এবং মিষ্টি পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে সংশ্লিষ্ট ৭ হাজার ২ হেক্টর জমিতে বছরে ৩৭০ কোটি ৮০ লাখ টাকার ফসল উৎপাদন করা সম্ভব হবে।
তেরআউলিয়া খালের ইজারাদার মইনুদ্দিন মিস্ত্রি বলেন, খালটি মূলত স্লুইসগেট গেটসংলগ্ন। স্লুইসগেট গেটের জলকপাট নষ্ট থাকায় অনিচ্ছাকৃতভাবে নোনাপানি ঢুকেছে। এখন জলকপাট সংস্কার হয়েছে। আর লোনাপানি উঠবে না।
উপজেলা জলমহাল কমিটির সভাপতি ও কয়রার ইউএনও বি এম তারিক-উজ-জামান বলেন, স্থানীয়ভাবে রাজস্ব আয়ের স্বার্থে খাল ও জলাশয় ইজারা দেওয়া হয়। এর নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, সেখানে কোনোভাবে নোনাপানি তোলা যাবে না। কেউ যদি গোপনে নোনাপানি তুলে কৃষকের ক্ষতি করে থাকে, তাহলে ইজারা বাতিল করা হবে।