যশোরের কেশবপুর উপজেলার অজপাড়াগাঁয়ের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়। তিন দশকের বিদ্যালয়টি খেলায় নৈপুণ্য দেখিয়ে সুনাম কুড়িয়েছে। এখানকার অনেক ছাত্রী জাতীয় দলের হয়ে খেলে তাক লাগিয়েছেন।
বিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু ১৯৯৩ সালে। বর্তমানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ২৩০, শিক্ষক ১৫ জন। প্রতিষ্ঠার পর থেকে বালিকা বিদ্যালয়টিতে খেলাধুলার চর্চা শুরু হয়। তবে তেমন কোনো সাফল্য ছিল না। ২০১২ সালে কেশবপুর গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয় উপজেলা পর্যায়ে প্রথমবারের মতো খেলাধুলার প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। ওই বছর আন্তবিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় উচ্চলাফ ও দীর্ঘলাফে উপজেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। এরপর জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। তবে বিভাগীয় পর্যায়ে গিয়ে তারা উচ্চলাফ ও দীর্ঘলাফে তৃতীয় স্থান পায়।
এরপর সবাই যেন নড়েচড়ে বসে। জোরেশোরে শুরু হয় খেলাধুলার চর্চা। দলীয় পর্যায়ে মেয়েদের ফুটবল, ক্রিকেট, হকি, ভলিবল, কাবাডি, হ্যান্ডবল, রাগবি, খো খো খেলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ব্যক্তিপর্যায়ে দৌড়, উচ্চলাফ, দীর্ঘলাফ, বর্শা নিক্ষেপ, লৌহগোলক নিক্ষেপ, ব্যাডমিন্টন, দড়িলাফ, সাইক্লিং, সাঁতার, দাবা ও ক্যারম খেলার চর্চা করানো হয়। ২০১৪ সালে গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় খেলে সাফল্য পায়।
বিদ্যালয়টির ঝুলিতে জেলা পর্যায়ে হকিতে তিনবার চ্যাম্পিয়ন, কাবাডিতে দুবার ও হ্যান্ডবলে চারবার রানারআপ হওয়ার সাফল্য আছে। এ বছর ৫২তম শীতকালীন জাতীয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় (ছাত্রী) হকিতে রানারআপ হয়েছে গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের দল। ব্যক্তি ও দলীয় পর্যায়ে সব মিলিয়ে শতাধিক ট্রফি তাদের ঝুলিতে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভাত বসু বলেন, তাঁরা প্রথমে মেয়েদের হকি দল গঠন করেন। হকিতে মেয়েদের দল যেহেতু কম, ফলে সাফল্য পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি—এমন ভাবনা থেকে শুরুটা করেছিলেন। ২০১৪ সালে যশোর জেলা ক্রীড়া কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ মাকসুদুর রহমান তাঁদের হকি দল গঠন করতে উৎসাহিত করেন। তখন তাঁরা দল গঠন করে হকির চর্চা শুরু করেন। এখন জাতীয় নারী হকি দলে এই বিদ্যালয়ের একসময়ের ছাত্রী মুক্তা খাতুন, সোনিয়া খাতুন ও লিমা খাতুন খেলেন। জাতীয় দলের হয়ে ওমান ও সিঙ্গাপুরে খেলেছেন তাঁরা। এখন বিদ্যালয়ে ৩০ জনের একটি হকি দল আছে। তাদের স্বপ্ন, জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার।
বিদ্যালয়টি হকিতে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিবছর উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন, বিভাগীয় পর্যায়ে সাতবার চ্যাম্পিয়ন ও আঞ্চলিক পর্যায়ে (দুই বিভাগ মিলে) দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এ বছর হকিতে জাতীয় পর্যায়ে রানারআপ হয়েছে। ক্রিকেটে উপজেলায় ৫ বার ও জেলায় ৩ বার চ্যাম্পিয়ন, ফুটবলে উপজেলায় ৫ বার ও জেলায় ৩ বার চ্যাম্পিয়ন, কাবাডিতে উপজেলায় ১০ বার, জেলায় ৪ বার ও বিভাগীয় পর্যায়ে ১ বার চ্যাম্পিয়ন হয়। হ্যান্ডবলে উপজেলায় ১০ বার চ্যাম্পিয়ন এবং জেলায় ১ বার রানারআপ হয়। খো খো খেলায় একবার জেলা পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করেছে।
১০০ মিটার দৌড়ে ২০১৫ সালে জাতীয় পর্যায়ে লিমা খাতুন স্বর্ণপদক পান। মুক্তা খাতুন ২০১৪ সালে লৌহগোলাক নিক্ষেপে রৌপ্যপদক, পরের বছর জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে লৌহগোলকে স্বর্ণপদক এবং এরপরের বছর বর্শা নিক্ষেপ ও চাকতি নিক্ষেপে রৌপ্যপদক পান।
বিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এত ট্রফি পেয়েছে যে বড় একটি আলমারিতে আর জায়গা হচ্ছে না। প্রধান শিক্ষকের টেবিলের ওপর ট্রফি রাখা হচ্ছে। সেই টেবিলও প্রায় ভরে যাচ্ছে।
এখন জাতীয় নারী হকি দলে খেলছেন এই বিদ্যালয়ের ছাত্রী মুক্তা খাতুন। অথচ বাল্যবিবাহের শিকার হয়ে তিনি হয়ে যেতে পারতেন কোনো গৃহবধূ। শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনোর আগেই সাতবার মুক্তাকে বিয়ে দেওয়ার আয়োজন করা হয়েছে। তবে তিনি বিয়ে করতে চাননি। তাঁর স্বপ্ন ছিল খেলোয়াড় হওয়ার। তাঁর স্বপ্ন পূরণে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন শিক্ষকেরা।
সেই মুক্তা খাতুনের ঝুলিতে এখন ৯টি স্বর্ণপদক, ১১টি রোপ্যপদক ও ৭টি ব্রোঞ্জপদক। খেলাধুলায় সাফল্যের কারণে এখন তিনি যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্পোর্টস সায়েন্সে স্নাতক (সম্মান) শ্রেণিতে পড়ছেন। আর নৌবাহিনীর নিয়মিত খেলোয়াড় হিসেবে তিনি ভাতা পান।
মুক্তার সাফল্য আরও অনেক মেয়েকে এই পথে যেতে প্রেরণা জুগিয়েছে। তবে মেয়েদের চলার পথটা খুব মসৃণ নয় সব সময়। বিদ্যালয়ের হকি দলের খেলোয়াড় মাসকোবা জান্নাত বলে, তারা মাঠে খেলা করলে অনেকেই কটু কথা বলেন। তবে তারা সে কথায় কান না দিয়ে খেলার চর্চাটা চালিয়ে যায়।
জয়া মণ্ডল নামের এক খেলোয়াড় বলে, ‘বাড়ির লোকদের চেয়ে বাইরের লোকদের কথা বেশি শুনতে হয়। তখন বাড়ির লোকেরাও কিছুটা বিরক্ত হয়। তারপরও খেলে যাচ্ছি।’
মেয়েদের সমর্থন দিয়ে পাশে থাকায় অভিভাবকেরা প্রশংসার দাবিদার। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডক্লাব ফুটবলে সেরার পদক পাওয়া সোনিয়া খাতুনের বাবা ব্যাসডাঙ্গা গ্রামের মশিয়ার রহমান বলেন, ‘আশপাশের লোকেরা সব সময় বলে, কেন মেয়েকে খেলাধুলা করাচ্ছি? তাদের কোনো কথায় কান দিই না। মেয়েকে বলেছি তার মতো খেলে যেতে। আমি মেয়ের পাশে থাকব, কখনো পিছপা হব না।’
বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক শহিদুল ইসলাম বলেন, খেলার নানা সরঞ্জামের অভাব আছে তাঁদের। আবার যেসব সরঞ্জাম আছে, রক্ষণাবেক্ষণের জায়গার অভাবে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায় দ্রুত।
বিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষকের ভাষ্য, তাঁদের শিক্ষার্থীদের খেলাধুলামুখী করানোটা বড় চ্যালেঞ্জ। ছাত্রীরা বিদ্যালয়ে ভর্তি হলে তাদের মধ্য থেকে বেছে নিয়ে বিভিন্ন খেলার সঙ্গে যুক্ত করা হয়। তখন অনেক অভিভাবক রাজি হতে চান না। তাঁদের রাজি করানো বেশ কষ্টের। তবে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী থাকলে অভিভাবকদের বোঝানোটা অনেকটাই সহজ হয়ে যায়।
গড়ভাঙ্গা মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুপ্রভাত বসু বলেন, ‘এলাকাটি রক্ষণশীল হওয়ায় আমাদের অনেক প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়। যে মেয়েটিকে অভিভাবকেরা খেলতে দিতে চান না, প্রথমে তাঁদের পরিবারেরর ক্রীড়ানুরাগী কাউকে খুঁজে বের করে রাজি করানো হয়। তাঁরা তখন পরিবারের অন্যদের বুঝিয়ে মেয়েদের খেলতে পাঠান, এমন কত ঘটনাও আছে!’
গ্রামের একটি বিদ্যালয়ের মেয়েদের এমন সাফল্যের বিষয়ে কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) তুহিন হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টির ধারাবাহিক সাফল্য গৌরবের বিষয়। তাদের এগিয়ে নিতে যা যা করা দরকার, উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে করার আশ্বাস দেন তিনি।