নিকলীর গোড়াদিঘা গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। পঞ্চম শ্রেণির পর পড়তে চাইলে গ্রামের শিক্ষার্থীদের দুটি নদী পেরিয়ে যেতে হয় দূরের গ্রামে।
হাওর এলাকার গ্রামটির নাম গোড়াদিঘা। শুষ্ক ও বর্ষা—দুই মৌসুমেই গ্রামটিতে যাতায়াতের একমাত্র বাহন নৌকা। কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার সিংপুর ইউনিয়নের গ্রামটিতে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় নেই। পঞ্চম শ্রেণির পর পড়তে চাইলে দুটি নদী পেরিয়ে দূরের গ্রামে যেতে হয় গ্রামের শিক্ষার্থীদের।
মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে যাতায়াতে দিনে সময় লাগে ২ ঘণ্টা, খরচ হয় ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এতে দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীরা পঞ্চম শ্রেণির পর ঝরে পড়ে। ছেলেশিশুদের ঢুকে যেতে হয় কাজে। মেয়েরা বাল্যবিবাহের শিকার হয়। এমন পরিস্থিতিতে আজ শনিবার পালিত হচ্ছে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘বিনিয়োগে অগ্রাধিকার, কন্যাশিশুর অধিকার’।
বাংলাদেশ শিক্ষাতথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) ২০২২ সালের প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে মোট মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা (ইংরেজি মাধ্যম ও মাদ্রাসা বাদে) ১৮ হাজার ৯০৭। মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৮ লাখ ৮৯ হাজারের বেশি। মোট শিক্ষার্থীর প্রায় ৫৫ শতাংশ মেয়ে।
নিকলী উপজেলায় ১টি নিম্নমাধ্যমিক ও ৯টি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও ৬টি দাখিল মাদ্রাসা আছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী প্রায় ১১ হাজার।
সাত-আট দিনের বেশি বিদ্যালয়ে যেতে পারি না। যেদিন যাই, সেদিন অন্য ছাত্রীদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নিইএসএসসি পরীক্ষার্থী পাপিয়া আক্তার
৬৯০ ঘরের গ্রাম গোড়াদিঘায় জনসংখ্যা ৪ হাজারের মতো। বর্ষা মৌসুমে বেশির ভাগ গ্রামবাসীর পেশা মাছ ধরা। গ্রামে রিকশা–ভ্যান কিছু নেই। গ্রামের বাইরে যেতে হলে ছোট নৌকাই একমাত্র বাহন।
বিচ্ছিন্ন গ্রামটিতে তিনটি বিদ্যালয় আছে। গোড়াদিঘা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি সংস্থা পপি পরিচালিত পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ভাসমান বিদ্যালয় ও আইডিএফ পরিচালিত দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়। গ্রামের সবচেয়ে কাছাকাছি মাধ্যমিক বিদ্যালয় হচ্ছে দামপাড়া ইউনিয়নের আলিয়াপাড়া গ্রামে। যেখানে যেতে পাড়ি দিতে হয় ঘোড়াউতড়া ও ধনু নদী।
সিংপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলী প্রথম আলোকে বলেন, ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে দুর্ভোগে গোড়াদিঘার শিক্ষার্থীরা। প্রশাসনের কাছে বহুবার দাবি জানানোর পরও গ্রামটিতে মাধ্যমিক বিদ্যালয় হয়নি।
হাওরে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে যাদের পড়ালেখার আগ্রহ রয়েছে, তারা বাধা পেরিয়েও পড়তে যায়।নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা পারভীন
জনপ্রতিনিধি ও গ্রামবাসীরা জানান, গোড়াদিঘা থেকে শ খানেক ছাত্রছাত্রী আলিয়াপাড়ায় এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়তে যায়। ছেলেমেয়ের সংখ্যা প্রায় সমান। সকাল আটটার দিকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে নৌকার জন্য সিরিয়াল ধরতে হয়। বর্ষাকালে নদী ও কৃষিজমি—সব একাকার হয়ে থাকে। দুই নদী ও একটি খাল পেরিয়ে বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে নদী পেরিয়ে সিংপুর বাজারে নেমে হেঁটে বা অটোরিকশায় বিদ্যালয়ে পৌঁছাতে হয়। নৌকাভাড়া ৩০ টাকা করে ৬০ টাকা আর নাশতায় ২০ টাকা খরচ হয়। যাতায়াতের ধকল আর খরচের কারণে মাসে কয়েক দিনের বেশি বিদ্যালয়ে যায় না অনেক শিক্ষার্থী।
গ্রামের এসএসসি পরীক্ষার্থী পাপিয়া আক্তার বলল, ‘সাত-আট দিনের বেশি বিদ্যালয়ে যেতে পারি না। যেদিন যাই, সেদিন অন্য ছাত্রীদের কাছ থেকে পড়া বুঝে নিই।’
গোড়াদিঘা ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবদুল মোতালিব বলেন, গ্রামে মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলে এখনকার চেয়ে অন্তত তিন গুণ বেশি ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করত। তিনি জানান, এ বছর গ্রাম থেকে ২২ জন এসএসসি পরীক্ষা দেবে। পরীক্ষার্থীদের অর্ধেক মেয়ে।
নিকলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শাকিলা পারভীন বলেন, হাওরে বড় হওয়া শিশুদের মধ্যে যাদের পড়ালেখার আগ্রহ রয়েছে, তারা বাধা পেরিয়েও পড়তে যায়।
আলিয়াপাড়ায় যাইতে কয়টা নদী পার হইতে হয় বলেন! আর প্রতিদিন ৭০–৮০ টাকা খরচ করা যায়!শিক্ষার্থীর মা
ছয় বছর আগে বৃষ্টি আক্তার (১৬) ভাসমান বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় পাস করে। একসময় নাচ-গানে পারদর্শী বৃষ্টি এখন মায়ের সঙ্গে সংসারের কাজ করে। তার বাবা বকুল মিয়া মৎস্যজীবী। বাবার পক্ষে মেয়ের পড়াশোনার খরচ বহন করা সম্ভব নয়। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বৃষ্টি ও তার ভাইয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। ভাই এখন বাবার সঙ্গে মাছ ধরে।
পঞ্চম শ্রেণির পর শারীরিক প্রতিবন্ধী শিখা আক্তারের (১৫) পক্ষে দূরে গিয়ে পড়া সম্ভব হয়নি। বাবা মানিক মিয়া বলেন, গ্রামে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় থাকলে তাঁর মেয়ের পড়া বন্ধ হতো না।
নিকলী উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. নুরুজ্জামান হাবিব বলেন, গোড়াদিঘায় এখন পর্যন্ত নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় করার পরিকল্পনাও নেই।
মেয়েটির সঙ্গে যখন দেখা হয়, তখন তার হাতে মেহেদির হালকা ছাপ। ৭ সেপ্টেম্বর তার বিয়ে হয়েছে একই গ্রামের এক মৎস্যজীবীর সঙ্গে। মেয়েটি জানাল, সে এ বি নূরজাহান হোসেন উচ্চবিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী ছিল।
এত ছোট মেয়েকে কেন বিয়ে দিলেন, এমন প্রশ্নে মেয়েটির মা বলেন, ‘আলিয়াপাড়ায় যাইতে কয়টা নদী পার হইতে হয় বলেন! আর প্রতিদিন ৭০–৮০ টাকা খরচ করা যায়!’
পপির ভাসমান ক্লিনিকের প্যারামেডিক ফুলমালা আক্তার বলেন, এ গ্রামের বেশির ভাগ মেয়ের বাল্যবিবাহ হয়। অবশ্য ইউপি সদস্য আবদুল মোতালিব দাবি করেন, গ্রামে ২ শতাংশের কম বাল্যবিবাহ হয়।
বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার ৫০ শতাংশ।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, হাওরে নৌকা দিয়ে শিশুদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার ঝুঁকি আছে, ব্যয় তো আছেই। সরকার হাওর এলাকায় ওয়াটার বাস চালু করতে পারে। সেখানে শিক্ষার্থীরা বিনা মূল্যে পারাপারের সুযোগ পাবে। তিনি বলেন, হাওরের মতো চর ও পাহাড়ে এলাকাভিত্তিক বিদ্যালয় গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে হবে। দেশে শিক্ষার্থীপ্রতি বিনিয়োগ উন্নত দেশ, এমনকি প্রতিবেশী অনেক দেশের তুলনায় অনেক কম।
সরকার শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে উল্লেখ করে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, হাওর অঞ্চলের জন্য আরও বিদ্যালয় তৈরির একটি বড় পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। তবে এর আগে গোড়াদিঘার মতো দুর্গম গ্রামগুলোয় শিক্ষক পাঠিয়ে বা বিকল্প উপায়ে পাঠদান করা যায়, তা নিয়ে তিনি আলোচনা করবেন।
[প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি তাফসিলুল আজিজ]